![হকারদের মাথায় হাত](uploads/2024/03/07/1709785778.Lead.jpg)
একটি খেলার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি মূল্যায়ন করা হয় দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে। যে খেলা দর্শক গ্রহণ করেন তার জনপ্রিয়তা থাকে আকাশচুম্বি। তাইতো বিশ্বে ফুটবলের জনপ্রিয়তার কাছে আর কোনো খেলাই নেই। আবার বাংলাদেশে সেই অবস্থা নেই। গলফার সিদ্দিকুর রহমান কিংবা আর্চার রোমান সানা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব ভালো করার পরও দর্শকরা গ্রহণ করেননি বলে তাদের সেই সাফল্য আড়ালেই পড়ে আছে। নেই কোনো জনপ্রিয়তা। পাশে নেই স্পন্সর।
বাংলাদেশে একসময় ফুটবল জনপ্রিয় থাকলেও এখন নেই। সেখানে স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেট। বিশ্বে যেমন ফুটবলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে তেমনি বাংলাদেশে ক্রিকেটের অবস্থান। বাংলাদেশের খেলা হলে দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দর্শকের এই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসকে পুঁজি করে জাতীয় দলের জন্য স্পন্সররা ভিড় জমায়। উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয় টিভি স্বত্ব। টিকিট হয় কালোবাজারি। বাংলাদেশের পতাকা, জাতীয় দলের জার্সি, ক্যাপ বিক্রি হয় দেদারছে। খাবার-দাবারের প্রতিষ্ঠানগুলোও ভালো ব্যবসা করে থাকে। কিন্তু সেই দর্শকরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেন তার প্রভাব কতোটা ভয়াবহভাবে পড়ে তা বুঝা যাচ্ছে সিলেটে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে।
শেয়ারের বাজারের অস্বাভাবিক দরপতনের মতোই বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টি-টোয়েন্টি সিরিজ নিয়ে দর্শকদের আগ্রহের প্রচণ্ড ভাটা পড়েছে। এই ভাটার টানে কাউন্টারে বসে যেমন টিকিট বিক্রেতারা অলস সময় পার করছেন, তেমনি এরকম সিরিজকে সামনে রেখে যারা মৌসুমি ব্যবসা করে থাকেন, তাদের মাথায় হাত। যেখানে আছেন স্টেডিয়ামের বাইরে হকার, টিকিট কালোবাজারি, স্টেডিয়ামের ভেতরে খাবার ব্যবসায়ী।
প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দর্শকদের অনাগ্রহ দেখে কালোবাজারিরা টিকিট বিক্রির সাহসই করেননি। কিন্তু বাংলাদেশের লড়াকু খেলা আর ঘরের ছেলে জাকের আলীর দুর্দান্ত ইনিংসের পর দ্বিতীয় ম্যাচ নিয়ে সিলেটবাসীর মাঝে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছিল। সেই আগ্রহ থেকেই দ্বিতীয় ম্যাচের আগে কালোবাজারিদের বেশ তৎপর দেখা যায়।
মোটরসাইকেল, রিকশা বা সিএনজি থেকে দর্শকরা নামার সঙ্গে সঙ্গেই কালোবাজারিরা টিকিট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যে দাম তারা হাঁকাচ্ছেন, তা শুনে চোখ কপালে উঠার মতোই। ২০০ টাকার টিকিটের দাম চাওয়া হচ্ছে মাত্র ২০ টাকা লাভে ২২০ টাকা। কেন এতো কম দাম চাওয়া হচ্ছে জানতে চাওয়া হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই হকার খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভাই দর্শকইতো নেই। বেশি দাম চেয়ে কার কাছে বিক্রি করবো।’ তিনি বলেন, বিপিএলের সময় এই ২০০ টাকার টিকিট ৫০০ টাকার ওপরে বিক্রি করেছি।’ মোটরসাইকেল আরোহী দুজন তার কাছ থেকে ২০ টাকা বেশি দামে দুটি টিকিট কিনে নেন। তিনি যে ২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে পেরেছেন, সে জন্য নিজেকে ভাগ্যবানই ভাবতে পারেন। কারণ টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দর্শকই নেই। মাঝে মাঝে এক-দুজন করে এসে নিজেদের পছন্দের টিকিট কিনে নিচ্ছেন নির্ধারিত দামেই। একই সঙ্গে মাইকে টিকিটের বিভিন্ন দাম উল্লেখ করে কাউন্টারে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে বলে কিছুক্ষণ পরপরই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল। নিজেদের টার্গেট অনুযায়ী টিকিট বিক্রি করতে না পারাতে কালোবাজারির অবয়ব কালো দেখাচ্ছিল। এভাবে যে তারা ব্যবসা করতে পারবেন না তা তাদের ভাবনাতেই ছিল না বলে জানান সেই কালোবাজারি। প্রথম ম্যাচের মতো দ্বিতীয় ম্যাচেও হয়নি আশানুরূপ দর্শক।
কালোবাজারিদের মতোই অবস্থা স্টেডিয়ামের বাইরে জাতীয় পতাকা, জাতীয় দলের জার্সি আর ক্যাপ বিক্রেতাদের। গুলিস্তান খেলাধুলার মার্কেট থেকে এসব কিনে ঢাকার রায়েরবাগ থেকে প্রায় ২৫ জনের মতো এসেছেন বিক্রি করতে। থাকেন লালবাজার একটি বোর্ডিংয়ে। প্রতিদিনের ভাড়া ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে এক একজনের প্রতিদিনের খরচ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ এই টাকাই তারা বিক্রি করতে পারছেন না। এরা সবাই ঢাকার পাশাপাশি সিলেট ও চট্টগ্রামেও এভাবে দল বেঁধে এসব বিক্রি করে থাকেন। ভালো লাভ হয় বলেই তারা বিপিএল ও আন্তর্জাতিক ম্যাচের সময় এই ব্যবসা করে থাকেন। কিন্তু এবার তাদের মাথায় হাত। ব্যবসা একেবারেই মন্দা যাচ্ছে। এরকম মন্দা অবস্থা অতীতে কখনো হয়নি বলে একাধিক বিক্রেতা জানিয়েছেন। এমনকি বিপিএলেও অনেক ভালো ব্যবসা হয়েছে বলে জানান তারা। প্রায় ষাটোর্ধ্ব নবী হোসেন মাথায় হাত দিয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথম টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ৩০০ টাকা বিক্রি করেছি। আজ (গতকল) এখন পর্যন্ত (বিকেল ৫টা) ৩০ টাকা (পকেট থেকে টাকা বের করে দেখিয়ে) বিক্রি করেছি। ব্যবসার যে অবস্থা এবার ঢাকা থেকে টাকা এনে যেতে হবে।’ নবী হোসেনের চেয়ে কিছুটা ভালো ব্যবসা করেছেন তার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট মোহাম্মদ সাঈদ। তিনি প্রথম দিন ৩ হাজার টাকার মতো বিক্রি করেছেন। এই ম্যাচে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তার বিক্রির পরিমাণ ৭০০ টাকার মতো। তিনি বলেন, ‘বিপিএলে এক-এক দিন ৭ হাজার, ৮ হাজার এমনকি ১০ হাজার টাকাও বিক্রি হয়েছে।’
স্টেডিয়ামের ভেতর দর্শকদের জন্য খাবার বিক্রি করে থাকে অনেক প্রতিষ্ঠান। সবাই ঢাকা থেকে বিসিবিকে টাকা দিয়ে ব্যবসা করার অনুমতি নিয়েছেন। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান লামিয়া। ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। এই প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটার সোহেল খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিসিবিকে অনেক টাকা (টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেননি) দিয়েছি। প্রতিবারই সব মিলিয়ে ভালোই লাভ হয়। এবার অনেক ক্ষতি হবে।’ তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট খেলায় এসব বিক্রি করা আমার নেশা হয়ে গেছে।’