![নাহিদ রানা: রূপকথাও হার মেনেছে যেখানে](uploads/2024/03/23/1711167717.Nahid-Rana.jpg)
রূপকথার গল্পে অনেক নায়ক থাকেন। স্বপ্নের ডানা মেলে ইচ্ছেমতো সেই নায়কের বীরত্ব গাঁথা লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবের নাহিদ রানার কাছে যেন সেই রূপকথার গল্পের নায়কও হার মেনেছে! কি বিস্ময়কর উত্থান? বয়স মাত্র ২১। তবে প্রথম বল হাতে তুলে নিয়েছেন ২০২১ সালে ১৮ বছর বয়সে। মাত্র ৩ বছরেই খুলে গেছে জাতীয় দলের দরজা। তাও অভিজাত টেস্ট ক্রিকেটে। খেলেননি কোনো বয়সভিত্তিক দলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে হইচই করার মতো এমন কোনো সাফল্য নেই, যা তাকে নিয়ে আসবে লাইমলাইটে। শুধুমাত্র গতি দিয়েই জাতীয় দলে প্রবেশ করে নাহিদ রানা রূপকথাকেও হার মানিয়েছেন।
এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন, যাদের জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে কতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। পারফর্ম করার পরও দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারেন জাকের আলী। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। ২২ গজে ফিনিশারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ভালো করে গেছেন নিয়মিত। উইকেটের পেছনেও গ্লাভস পরে নিয়মিত সাফল্য পেয়েছেন। জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা তার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি ডাক পাচ্ছিলেন না। এ নিয়ে কানাঘুষা-সমালোচনাও চলতে থাকে। অবশেষে অনেক প্রতীক্ষার পর জাকের আলী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দলে ডাক পান। তাও আলিস ইসলাম ইনজুরিতে পড়লে। সে তুলনায় নাহিদ রানার কাছে মনে হবে জাতীয় দলে খেলা কতো সহজ!
নাহিদ রানা যদি সে রকম কিছু মনে মনে ভেবেও থাকেন, তাহলে তার সে ভাবনাকেও ভুলও বলা যাবে না। জাতীয় দলে খেলার জন্য যে সব ধাপ পার হয়ে আসতে হয় নাহিদ রানাকে তার কোনো কিছুই করতে হয়নি! ১৮ বছর বয়সে ক্রিকেটে আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি রাজশাহীর ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে। এর আগ পর্যন্ত তিনি এসেছেন নিজ থেকেই। টেনিস বল, টেপ টেনিস বল দিয়ে পাড়ায় খেলতেন। প্রথমে টেনিস বল হাতে বল করতে গিয়ে দেখেন বেশ জোরে হচ্ছে। তারপর সেই গতি আরও বাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন। এভাবেই এগোতে থাকে তার ক্যারিয়ার। কিন্তু এ পর্যন্ত আসতে তিনি পরিবার থেকে প্রচণ্ড বাধার মুখে পড়েছিলেন। পারিবারিক শর্ত ছিল এসএসসি পাস করতে পারলে ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি করে দেওয়া হবে। খেলা পাগল নাহিদ রানা এসএসসি পাস করার পর পরিবার থেকে তাকে ক্লেমন একাডেমিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধুই সামনে এগিয়ে চলা, নিজেকে মেলে ধরা।
ক্লেমন একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পর জাতীয় দলের সাবেক পেসার রাজশাহীর আরেক সন্তান আলমগীর কবীরের নজরে পড়েন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই তরুণ। নজরে আসেন জাতীয় দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তরও। তারাই তাকে বড় মঞ্চে খেলার সুযোগ করে দেন। সেটি ছিল এনসিএল। সেই মৌসুমে তিনি দুটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। খুব একটা নজরে পড়েননি। কিন্তু পরের মৌসুমে তিনি ঝড় তোলেন। গতির সঙ্গে নেন উইকেটও। ৬ ম্যাচ খেলে তার ঝুলিতে জমা পড়েছিল আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২ উইকেট। ব্যস, শুরু হয় দুরন্ত গতিতে পথ চলা। আর রুখে কে? ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে জমজমাট আসর বিপিএলে খুলনা টাইগার্সের হয়ে দুই ম্যাচ খেলে উইকেট দুটি নিলেও গতি দিয়ে তিনি লাইমলাইটে চলে আসেন। নজরে পড়েন সর্বত্র। যার ফলশ্রুতিতে তিনি এখন টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১০৩তম ক্রিকেটার। এখানে প্রবেশ করার সময় তার নামের পাশে আছে ১৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৬৩টি উইকেট। সেরা বোলিং ইনিংসে ৬২ রানে ৫ উইকেট। ম্যাচে ১২৭ রানে ৯ উইকেট। লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ৪টি। উইকেট নিয়েছেন ১০টি। আর টি-টোয়েন্টি ৫ ম্যাচ খেলে নামের পাশে উইকেট ৪টি।
ঘরোয়া আসরে নজরে পড়ার পর নাহিদ রানাকে এইচপি (হাইপারফরম্যান্স ইউনিট)তে ডাকা হয়। এ ছাড়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ক্যাম্পে ছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত দলে জায়গা করে নিতে পারেননি। কিন্তু জাতীয় দলের জন্য কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি। গতকাল তার মাথায় ক্যাপ পরিয়ে দেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। এ সময় তিনি তার কাছে দেশের জন্য ভালো কিছু প্রত্যাশা করার কথা বলেন।
টেস্ট ক্যাপ পরলেও তার বোলিং দেখার জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। কারণ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত টস জেতার পর বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলে নাহিদ রানার বোলিং দেখার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেন। কারণ তিনি যে গতিময় বোলার তা সাধারণ ক্রীড়ামোদীরা জানতে পেরেছেন জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর। ১৪৯.৭০ গতিতে বোলিং করা নাহিদ রানার বোলিং দেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিকই। ইনিংসের নবম ওভারে বল হাতে তুলে নেওয়ার পর তিনি নিয়মিত ১৪০-এর ওপরে বোলিং করে গেছেন। শুরুতে নিজের গতি ধরে রাখতে পারলেও উইকেট নিয়ে কিন্তু সবার মন ভরাতে পারেননি নাহিদ রানা। তবে শেষ সেশনে তা পুষিয়ে দেন ৩ উইকেট নিয়ে। তার শিকারও ছিল বেশ মোটাসোটা। দুই সেঞ্চুরিয়ান কামিন্দু মেন্ডিস (১০২) ও অধিনায়ক ধনঞ্জায়া ডি সিলভার (১০২) সঙ্গে প্রভাত জয়াসুরয়িার (১) উইকেট নিয়ে তার প্রতি সবার প্রত্যাশার মাঝে আনন্দের রেনু ছড়িয়ে দেন। প্রথম দুই সেশনে ৩ স্পেলে ৮ ওভার বোলিং করে ৫৮ রান দিয়ে উইকেট শূন্য ছিলেন। সেখানে চতুর্থ স্পেলে ৬ ওভারে ২৯ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। তার বোলিং ফিগার ছিল এমন, ১০-২-৮৭-৩।
দিনশেষে নাহিদ রানাকে নিয়ে পেস বোলিং কোচ আন্দ্রে অ্যাডামস করেছেন ভূয়সী প্রশংসা। তিনি বলেন, ‘সে প্রতিভাবান, দ্রুত গতিসম্পন্ন। তার প্রায় প্রতিটি বল ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে ছিল। তার বোলিং অ্যাকশনও সুন্দর। সে মাত্রই শুরু করেছে। সে ঠিক এতটাই কাঁচা। তার অনেক কিছু শেখার আছে। সে খুবই মেধাবী।’