![যারা স্বপ্ন দেখে না তারা কিসের নায়ক](uploads/2024/06/27/t20-1719466947.jpg)
সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য ক্রিকেটাররা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালেও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলেছেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে হঠাৎ করে সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ চলে আসার পর তার পেছনে ছোটার কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি শান্তদের মাঝে। এমনটি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ক্রিকেটারদের প্রতি ভালোবাসা আর আন্তরিকতার পরিবর্তে সেখানে জায়গা পেয়েছে তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা।
ম্যাচের এক দিন আগেও যেখানে ছিল উপচে পড়া ভালোবাসা আর দুর্নিবার আকর্ষণ। তবে আফগানিস্তানের কাছে নতজানু হার তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ক্রিকেটারদের নামও মুখে আনতে যেন তাদের ইচ্ছা হচ্ছে না। কুইন্সের জ্যাকসন হাইটস, ব্রোঞ্চের স্টালিং নামক স্থানে সব সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকে। কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে তারা এসব জায়গায় বসে সময় কাটান। যেখানে স্থান পায় বাংলাদেশের বিদ্যমান সামাজিক অবস্থা বা ঘটনা। সেখানে গত কয়েক দিন ছিল শুধুই বাংলাদেশের ক্রিকেট। প্রথমে ছিল আগ্রহ, পরে সমালোচনা আর ক্ষোভের আগুন!
এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ দল খুব একটা ভালো করতে পারেনি। বলা যায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তারা এক একটি ম্যাচ জিতে সুপার এইটে জায়গা করে নিয়েছিল। সুপার এইটে প্রতিপক্ষ দেখে বাংলাদেশ দল যে ভালো কিছু করতে পারবে না, এটা প্রবাসীরা ধরেই নিয়েছিলেন। তাই তো প্রথমে অস্ট্রেলিয়া, পরে ভারতের কাছে হারে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। খেলার দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ব্যথিত করেছে। তার পরও হালকা-পাতলা সমালোচনা করে তারা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা ধরেই নিয়েছেন দলের সীমাবদ্ধতা। এর থেকে ভালো কিছু করা সম্ভব না। আশা করাও ঠিক না। কিন্তু হঠাৎ করে সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ চলে এলে এসব দর্শকই আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। প্রথমে অনেকেই বিশ্বাসই করতে পারেননি। তাদের এই বিশ্বাস না করার পেছনে অনেক যুক্তিসংগত কারণও ছিল। কারণ বাংলাদেশ কোনো ম্যাচই জেতেনি। কোনো ম্যাচ না জিতেও সেমিফাইনালে খেলার লড়াইয়ে শামিল হওয়া যায়, এটা যেন এবারই তারা প্রথম দেখছেন।
তিন কাঠির খেলা ক্রিকেটকে বলা হয়ে থাকে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। এর প্রতিটি বাঁকে আছে রহস্য আর উত্তেজনার ঝাঁজ। তাই বলে এভাবেও সেমির লড়াইয়ে থাকা যায়! কর্মব্যস্ত প্রবাসী জীবনে নিজেদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে যান ক্রিকেটের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায়। মেলাতে থাকেন বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ। চলে নানা কথাবার্তা। এমন সুযোগ কি বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারবে? এ নিয়ে আশার চেয়ে শঙ্কাবাদীর সংখ্যাই বেশি ছিল। এই শঙ্কাবাদীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ সেমিতে খেলতে হলে শুধু জিতলেই হবে না, একটা নির্দিষ্ট টার্গেট নিয়ে জিততে হবে। তবেই যদি সম্ভব হয়। এই সমীকরণই প্রবাসীদের বেশি শঙ্কিত করে তোলে। কারণ তারা জানতেন বাংলাদেশ দলের সীমাবদ্ধতা।
বুকভরা আশা নিয়ে অনেকেই দল বেঁধে বসেছিলেন টিভির সামনে। আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতি। তাদের অনেকেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে থাকেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা ছিল সেন্ট ভিনসেন্টে। এই সেন্ট ভিনসেন্টেই বাংলাদেশ দল গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ দুই ম্যাচে নেদারল্যান্ডস ও নেপালকে হারিয়ে সুপার এইটের টিকিট পেয়েছিল। নেপালের বিপক্ষে জয় ছিল ভাবনারও অতীত। মাত্র ১০৬ রানের পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছিল ২১ রানে। অনেকেই লাকি গ্রাউন্ড বলেও মন্তব্য করেন। এবার যদি সেই সেন্ট ভিনসেন্টে আবার নতুন করে কিছু হয়। কিন্তু সবই ছিল অন্তরে লালিত স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন যে আবার ক্রিকেটারদের মাঝে ছিল না। নিজেদের যোগ্যতায় নয়, অন্য দলের বদান্যতায় কুড়িয়ে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগাতে যে ক্রিকেটারদের মাঝে ন্যূনতম কোনো আগ্রহ ছিল না। কারণ তারা শুধু খেলে যান। কোনো স্বপ্ন দেখেন না। তাই তো স্টারলিংয়ে কয়েকজন মিলে খেলা দেখা একজন নোয়াখালীর রইসউদ্দিন বলেন, ‘যাদের আমরা স্বপ্নের নায়ক ভাবি, তারা তো স্বপ্নই দেখেন না। তাহলে তারা কিসের স্বপ্নের নায়ক। শুধু শুধু তাদের মাথায় তুলে নাচি। তারা খেলছেন আর নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের আবেগের কোনো মূল্যই নেই তাদের কাছে।’ পাশে থাকা চট্টগ্রামের তরুণ হায়দার যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না সেমিতে যাওয়ার সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা না করাটাকে। তিনি নিজেও একসময় টুকটাক ক্রিকেট খেলতেন। পড়াশোনার জন্য চলে এসেছেন মার্কিন মুলুকে। বলেন, ‘আমরা সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য খেলিনি, জেতার জন্য খেলছি। কিন্তু জিততেও তো পরিনি। ম্যাচ জিতলেও না হয় একটা সান্ত্বনা পেতাম। আর এ কেমন খেলা। আমরা নতুন করে তো আর ক্রিকেট খেলছি না। এতদিন থেকে ক্রিকেট খেলছি। এ রকম বাজে দল আমি আগে আর দেখিনি। দলের ব্যাটিং দেখেও লজ্জা পেয়েছি। পাড়া-মহল্লার ব্যাটিং।’ হায়দারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সিলেটের হাসান বলেন, ‘আরে ভাই ওরা তো দেশের জন্য খেলে না। নিজেদের জন্য খেলে। সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য খেলতে গিয়ে হেরে গেলে কোনো লাভই হতো না। তার চেয়ে ম্যাচ জিততে পারলে জেতার জন্য বাড়তি টাকা পেত, আবার ম্যাচ জেতার জন্য পরিসংখ্যানও বাড়ত। এক বিশ্বকাপে চারটি জয়। আগে কখনো এত জয় ছিল না। দেখতেন এটিকেই তখন অনেক বড় করে প্রচার করা হচ্ছে।’
জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বকাপ কাভার করতে এসেছি জানার পর প্রবাসীদের ক্ষোভ যেন আরও বেশি উগলে পড়ে। ঢাকার কামাল বলেন, ‘আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা দেখার পর মনে হচ্ছে কেন ডালাস আর নিউইয়র্কে গিয়ে খেলা দেখেছি। দেশের টানে ছুটি নিয়ে শত শত ডলার খরচ করে খেলা দেখতে গিয়েছি, ক্রিকেটারদের মাঝে তো সেই টান দেখলাম না। যদি তাদের মাঝে সেই টান থাকত, তাহলে সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য তারা অলআউট খেলত। এরপর না হয় হেরে যেত। তখন তাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসাটা আগের মতোই থাকত।’ কামালের সঙ্গে থাকা নারায়ণগঞ্জের মাকসুদ যোগ করে বলেন, ‘ধরেন, বাংলাদেশ ২০ ওভার খেলে জিতে গেল। তাতে কী লাভ হতো। এটা তো শুধুই একটা জয় হয়ে থাকত। সেখানে সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করাটা ভালো হতো না? আমরা সাধারণ দর্শক হয়ে এটা বুঝি, ক্রিকেটাররা বোঝেন না!’ তিনি কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সুপার এইটে খেলাটাকে বোনাস হিসেবে বলা কথারও প্রচণ্ড সমালোচনা করেন। এখানেই বাংলাদেশের সুপার এইটে খেলার সব অর্জন বিসর্জন হয়েছে বলে জানান।