![‘মায়ের খুশিটাই আমার খুশি’](uploads/2024/06/28/mother-1719549869.jpg)
এবারের ঈদুল আজহার দিনে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে অভাবনীয় এক সাফল্যের আনন্দ এনে দিয়েছিলেন আর্চার সাগর ইসলাম। তুরস্কের আন্তালিয়ায় ‘২০২৪ ফাইনাল ওয়ার্ল্ড কোটা টুর্নামেন্ট’-এ সেমিফাইনালে ওঠার মধ্যে দিয়ে সরাসরি প্যারিস অলিম্পিকের টিকিট নিশ্চিত করেন তিনি। পরে প্রতিযোগিতার ফাইনালে ওঠে জিতে নেন রুপা। বাংলাদেশের মাত্র তৃতীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে খেলবেন সাগর। তুরস্ক থেকে দেশে ফেরার পর বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দিয়েছে আর্চারি ফেডারেশন। শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাগরের মা সেলিনাও। কীভাবে তিনি চায়ের দোকান করে ছেলেকে এত দূর এনেছেন, মঞ্চে সেই গল্প তুলে ধরছিলেন সাগর নিজেই। অলিম্পিকে খেলার আনন্দের চেয়েও মাকে খুশি করতে পারার আনন্দটাই বেশি ছিল তার।
সাগরের সাফল্যকে অভাবনীয়ই বলতে হবে। এর আগে গলফার সিদ্দিকুর রহমান ও আর্চার রোমান সানা বাংলাদেশ থেকে কোটা প্লেস অর্জনের মাধ্যমে সরাসরি অলিম্পিকে খেলেছেন। ২০১৬ অলিস্পিকে সিদ্দিকুর ও ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন রোমান। এই দুজন যখন সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন, তখন দুজনই নিজ নিজ খেলায় প্রতিষ্ঠিত তারকা। সাগর সেখানে একেবারেই তরুণ। মাত্র ১৮ বয়স তার। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন একাদশ শ্রেণিতে।
রাজশাহী থেকে প্যারিসের পথে তার যাত্রার গল্পটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই। ২০০৯ সালে তার বাবা মারা যান। টেম্পো মিস্ত্রি হিসেবে সংসার চালাতেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর সেলিনা চার সন্তানকে মানুষ করতে অনেক সংগ্রাম করেন। ভিটে মাটি বলতে কিছু নেই তাদের। এখনো ভাড়ায় থাকেন। রাজশাহী বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে চায়ের দোকান চালিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন তিনি। মঞ্চে মাকে পাশে রেখে সাগর শোনালেন সেই গল্প, ‘তিন বছর বয়সে আমার বাবা মারা গেছেন। মা চায়ের দোকান করে আমাদের চার ভাইবোনকে বড় করেছেন। সবাইকে কলেজ পাস করিয়েছেন, বড় ভাই, দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। আমি খেলাধুলায় এসেছি। মা কখনো বুঝতে দেননি আমাদের অর্থনৈতিক দিকটা অনেক দুর্বল। যখন যা চেয়েছি, সেটাই পেয়েছি। মা পেছন থেকে সব সময় সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। বলেছেন, তুমি শুধু খেল। তোমার কি লাগে বলো। তোমার কোনো টেনশন নেই।’
খেলার প্রতি ছোটবেলা থেকেই টান ছিল সাগরের। ছেলের এই আগ্রহ দেখেই রাজশাহীর এক আর্চারি ক্লাবে সাগরকে ভর্তি করান মা। এরপর সেখান থেকে বিএসপিতে সুযোগ করেন। এখন জাতীয় দলের হয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। ২৬ জুলাই শুরু হতে যাওয়া প্যারিস অলিম্পিকে খেলবেন তিনি। যে অলিম্পিকের মঞ্চে পা রাখা যেকোনো ক্রীড়াবিদের জন্যই স্বপ্ন।
গত ১৭ জুন অলিম্পিকের পদক নিশ্চিত হওয়ার পর তুরস্ক থেকে সাগর ফোন করেন মাকে। তবে তার ফোনের আগেই মার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ছেলের সাফল্য। সাগর সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘মার কথা শুনে তখন মনে হচ্ছিল আমি সফল ছেলে। মা আমার জন্য এত কষ্ট করেছেন। আমার প্রথম চাওয়াই তো হলো আমার মা যেন খুশি থাকেন। মার খুশিটাই আমার খুশি। আমি সব সময় চেষ্টা করি আমার মা যেন খুশি থাকেন।’
আর ছেলের সাফল্যে গর্বিত মা বলেন, ‘আপনারা আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। আমার ছেলেকে আল্লাহ যেন অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসার তৌফিক দান করেন। আমার ছেলে যেন আপনাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করতে পারে, এটাই আমার প্রত্যাশা।’ এই যে ছেলেকে এত কষ্ট করে মানুষ করেছেন, আজ সেসবের কোনো কিছুকেই কষ্ট মনে করছেন না তিনি। ‘কষ্টের কথা আমার মনে নেই। কষ্ট আমি ভুলে গেছি। মা যেমন একজন সন্তান জন্ম দিয়ে কষ্টের কথা মনে রাখে না। আমি যত কষ্ট করেছি আমার সন্তানদের জন্য, আজ সব ভুলে গেছি আমি। আমি খুব আনন্দিত ও গর্বিত।’
এদিন বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের পৃষ্ঠপোষক সিটি গ্রুপের পক্ষ থেকে সাগরকে ৫ লাখ টাকা অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়। সাগর বলছিলেন, ‘মার সঙ্গে কথা বলে যেটা ভালো হবে, সেটাই করব।’ আর মায়ের কথা, ‘এটা সাগরের কাজে লাগুক। আমার ছেলে অর্জন করেছে, আমার ছেলের কাজে লাগুক।’ সরাসরি অলিম্পিকে খেলা নিশ্চিত করে এখন অলিম্পিক পদক জয়েরও প্রত্যাশা রাখছেন সাগর, ‘স্বপ্ন চূড়ায় থাকবে। ইনশা আল্লাহ যেন গোল্ড মেডেল নিয়ে আসতে পারি।’