উন্নত জাতের বীজ চাষ করলে ভালো মানের পেঁয়াজ পাওয়া যাবে। এ আশায় মেহেরপুর জেলায় ৫২০ জন কৃষক সরকারি প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজ জমিতে চাষ করেছিলেন। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও গাছে এখনো পেঁয়াজ আসেনি।
মেহেরপুর জেলার ৫২০ জন চাষিকে পেঁয়াজ আবাদ বৃদ্ধির জন্য সরকারি প্রণোদনার আওতায় বীজ ও সার-সহায়তা দেয় কৃষি অফিস। ভারত থেকে আমদানি করা নাসিক রেড এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজের বীজ দেওয়া হয় জেলার ৩ উপজেলার কৃষকদের। কেউ বীজ বপন করে আবার কেউ চারা তৈরি করে পেঁয়াজ চারা রোপণ করেছিলেন।
কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী পেঁয়াজের জমিতে পরিচর্যা করেছেন কৃষকরা। রোপণের তিন মাসের মধ্যে পরিপক্ব পেঁয়াজ পাওয়ার কথা থাকলেও এখন মিলছে শুধুই শিকড়। নভেম্বর মাসে খেতে পেঁয়াজ চারা রোপণ করলেও এখন পর্যন্ত পেঁয়াজ গাছগুলোতে পেঁয়াজ ধরেনি। খেতগুলোতে পুষ্ট পেঁয়াজ গাছ থাকলেও তার গোড়ায় কোনো পেঁয়াজ পাচ্ছেন না চাষিরা। একসময় গাছে পেঁয়াজ ধরবে সে আশায় চাষিরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে গাছে প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশক দিচ্ছেন। কিন্তু গাছ তুললে গোড়াতে শিকড় ছাড়া কোনো পেঁয়াজের দেখা মিলছে না। কৃষি অফিসের কাছ থেকে কোনো ধরনের সদুত্তোর না পেয়ে পেঁয়াজের আশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক কৃষক।
গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের ৫ থেকে ৬ জন কৃষক উপজেলা কৃষি অফিস থেকে গত বছরের অক্টোবরে সরকারি প্রণোদনার নাসিক রেড এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজের বীজ নিয়েছিলেন। পেঁয়াজ উত্তোলনের সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের গাছে এখনো পেঁয়াজ ধরেনি।
কৃষক তৌহিদুল ইসলাম জানান, তার দেড় বিঘা জমিতে সরকারি প্রণোদনার বীজ নিয়ে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন। পেঁয়াজখেতের পরিচর্যায় ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। উচ্চমূল্যের বাজারে প্রতি বিঘা জমির পেঁয়াজ আড়াই লাখ টাকার পর্যন্ত বিক্রি করছেন অনেক কৃষক। কিন্তু তার জমিতে পেঁয়াজের পরিবর্তে পাওয়া যাচ্ছে শুধুই পেঁয়াজ গাছের শিকড়। অনুদানের পেঁয়াজ চাষ করে বর্তমানে তিনি লোকসান গুনছেন। সার কীটনাশক কিনতে অর্থ ব্যয় হয়েছে। গাছে পেঁয়াজ না হওয়ায় সেই টাকাও ওঠে আসবে না। এতে পরবর্তী সময়ে কীভাবে পেঁয়াজ চাষ করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
অপর কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি প্রণোদনার বীজ নিয়ে জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে বিপদে পড়েছি। যেসব কৃষক সরকারি প্রণোদনার বীজ নিয়ে পেঁয়াজ আবাদ করেছি শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছি। প্রতি বিঘা পেঁয়াজ আবাদে ৪০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে।’
শুধু গাংনী উপজেলা নয়, জেলার বেশির ভাগ কৃষকের একই অবস্থা। কৃষকরা বলছেন, সরকারি বীজে ভালো ফলন হবে সে আশায় পেঁয়াজ আবাদ করেছিলেন। কিন্তু তাদের জানানো হয়নি শীতকালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ লাগালে গাছে পেঁয়াজ হবে না। সরকারি কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে কৃষকরা লোকসান গুনছেন।
কৃষকদের অভিযোগ সম্পর্কে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশরাফুল আলম জানান, ইতোপূর্বে নাসিক এন-৫৩ জাত পরীক্ষামূলকভাবে নাটোরে চাষ করা হয়েছিল। বাস্তবে দেখা গেছে, যারা আগাম লাগিয়েছিলেন তাদের ফলন ভালো হয়েছিল কিন্তু দেরি করে আবাদের ফলে অনেকেরই ফলন কম হয়। তখন ধারণা করা হয়, সার দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিমাণের তারতম্যের কারণেও এমনটি হতে পারে। তবে সাধারণত জুন-জুলাইয়ে এই জাতটি আবাদ করার সঠিক সময়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারত থেকে নাসিক রেড এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজটি একজন আমদানিকারক জানান, গত বছর দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩৪ দশমিক ৫ টন এই জাতের পেঁয়াজের বীজ কিনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। যখন আমদানি করা হয় তখন চাষ না করে দেরিতে চাষ করার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
বিএডিসি ভারত থেকে আমদানি করে কৃষি অফিসে সরবরাহ করে নাসিক রেড এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজ বীজ। তবে অমৌসুমের বীজ জেনেও চাষিদের মাঝে তা বিতরণ করা হলো সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি কৃষি অফিসের কর্মকর্তা।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদারকে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি নিয়ে কোনো সদুত্তোর দিতে পারেননি। বিএডিসি থেকে পেয়ে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করার দায়িত্ব তাদের ছিল বলেও জানান তিনি। সঠিকভাবে পরিচর্যা, সার, বিষ প্রয়োগ ও চাষাবাদের সব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলার তিনটি উপজেলায় ২ হাজার ২২০ কেজি পেঁয়াজের বীজ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া। যার মধ্যে ৭০০ জন কৃষককে ৫২০ কেজি বীজ দেওয়া হয় শীতকালে চাষ করার জন্য।
সম্প্রতি মাঠ দিবসে প্রদর্শনে আসা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বীজ বিতরণে দেরি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। আগামীতে সঠিক সময়ে পেঁয়াজের বীজ সরবরাহ করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, সদর উপজেলায় ১৬০ জন, গাংনী উপজেলায় ১৫০ জন ও মুজিবনগর উপজেলায় ২১০ জন কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়।