![দেশি বীজ রক্ষায় সাতক্ষীরার অল্পনার লড়াই](uploads/2024/06/30/seeds-1719724691.jpg)
বিভিন্ন জায়গা থেকে বীজ তোলা, শুকানো এবং অন্যকে বিতরণ করতে সময় লাগে। তারপরও কষ্ট করে সবকিছু করি। কারণ, হেরে যাবে বলে তো মানুষ লড়াই শুরু করে না। তা ছাড়া সবাই আমার কাছে আসে ভালোবেসে। দানের তো শেষ নেই, দান করলে পুণ্য হয়। এতে আমার মতো আরও পাঁচজন কৃষানি তৈরি হবেন। আর আমি যখন বীজ দিই তখন বলে দিই, দেখেন, এখন দিচ্ছি দ্বিতীয়বার আর দেব না। আমার মতো করে বাড়িতে বীজ তৈরি করে আমাকে দেখাতে হবে। কিছু প্রশিক্ষণ দিলে তারা বীজ তৈরি করে রাখেন। সে বীজ আমাকেও কিছুটা দেন। কথাগুলো বলেছেন উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামের কৃষি পদকপ্রাপ্ত অল্পনা রানি। ফসলের দেশীয় বীজ রক্ষায় যিনি করে যাচ্ছেন আপ্রাণ চেষ্টা।
জানা গেছে, মা-বাবার অভাবের সংসারে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় অল্পনা রানিকে। স্বামী গঙ্গারাম মিস্ত্রি ছিলেন ভ্যানচালক। অল্পনাকেও অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতে হতো। একটা সময় ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয় অল্পনার বসতভিটাসহ পুরো উপকূলীয় জনপদ। ওই সময় আয়ের কোনো উৎস না থাকায় শিশু সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন তারা। দিনের পর দিন থাকতে হয় অনাহারে। আইলার বিভীষিকাময় জীবন থেকে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়ে নিজ বসতভিটার ৩৩ শতক জমিতে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি রোপণ করেন অল্পনা। একই সঙ্গে শুরু করেন বীজ সংরক্ষণের কাজ।
এর কয়েক বছর পার না হতেই পরিশ্রমের ফল পেতে শুরু করলেন অল্পনা। গঙ্গারামও ভ্যান চালানো ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী অল্পনার কাজে সময় দিতে থাকেন। এভাবে একসময় অভাব ঘুচেছে গঙ্গারাম-অল্পনা দম্পতির সংসারে। কুঁড়েঘরের বদলে পাকাঘর উঠেছে বাড়িতে। এলাকার লোক এখন এক নামে চেনে অল্পনাকে। তার বাড়িটি এলাকায় ‘কৃষিবাড়ি’ নামে পরিচিত।
অল্পনা রানির বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায়, একটু জায়গাও পতিত পড়ে নেই। নিজ বাড়ির আঙিনা ও বসতভিটাকে ছোট ছোট প্লটে ভাগ করে তাতে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন বিষমুক্ত শাকসবজি চাষ করছেন। একই সঙ্গে বীজ রাখার ঘরে বয়াম (চীনামাটির বা কাচের তৈরি মোটা বোতল), প্যাকেট ও বস্তায় রাখা হয়েছে বীজ।
বর্তমানে অল্পনা তার কৃষি বাড়িতে দেশীয় জাতের চার শতাধিকেরও বেশি শাকসবজি ও ঔষধি গাছের বীজ সংগ্রহ করেছেন। বীজ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের কাজ নিজ হাতেই করেন তিনি।
অল্পনা পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়তে পারেননি। কিন্তু এখন হাজার হাজার নারীকে শেখাচ্ছেন কিভাবে বীজ সংরক্ষণ করতে হয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এলাকার নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে একটি সমিতিও গড়েছেন তিনি। নাম ‘ধুমঘাট শাপলা নারী উন্নয়ন সংগঠন’। ওই সংগঠনটির সভাপতিও অল্পনা। প্রতি মৌসুমে অল্পনা তার বীজ ভাণ্ডার থেকে শত শত মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বীজ বিতরণ করেন।
অল্পনা রানির মতে, স্থানীয় জাতের বীজ চাষাবাদে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে না। উৎপাদিত ফসলের বীজও সংরক্ষণ করা যায়। জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা যায় বলে মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে অল্পনা বলেন, ‘স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ না করলে কৃষককে কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যেতে হবে। এ জন্য স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে সাধারণ কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। বিষমুক্ত সবজির খামার গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় তো বীজ রোপণ করলে খরা হতে পারে, অতিরিক্ত বর্ষা হতে পারে, তখন তো কেনা বীজ নষ্ট হয়ে যাবে। কাছে টাকা না থাকলে কোম্পানির বীজ কেনা যাবে না। এতে অনেকে চাষাবাদও করতে পারবেন না। আর যখন দেশি বীজ আমার কাছে বয়ামে থাকবে, তখন একবারের জায়গায় পাঁচবার লাগাতে পারব।’
স্থানীয় বীজ সংরক্ষণে তিনি নিজে কিভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন জানতে চাইলে অল্পনা রানি বলেন, ‘আগে দু-একটি বীজ রাখতাম। ২০১২ সালে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক (বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ) আমাকে বীজ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে এর গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝায়। প্রশিক্ষণও দেয়। নানাভাবে সহায়তাও করে। বারসিকের উৎসাহ পেয়েই আমি বীজ সংরক্ষণ শুরু করি। যা এক যুগের ব্যবধানে বীজ ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে।’
বীজ সংরক্ষণ ও স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন জানিয়ে অল্পনা বলেন, ‘কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক, ২০২০ সালে অন্য পুরস্কার, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে জয়িতা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার পেয়েছি। দেশ বিদেশের টেলিভিশন চ্যানেল আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে আসে। আমার জীবনে আর কী চাওয়ার আছে।’