![মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক আদালত](uploads/2024/06/26/Shah-Nister-Jahan-1719379488.jpg)
পশ্চিমা গণমাধ্যম এখন ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বেশ ঝিম মেরে আছে। ইসরায়েলের আক্রমণ এবং তাদের গণহত্যার ব্যাপারে সব সংবাদ তারা প্রকাশ করছে না। প্রতিদিন কত শত নিরপরাধ মানুষ সেখানে মারা যাচ্ছে, তা থাকছে অনুল্লিখিত। তবে ইসরায়েল যে আক্রমণের ক্ষেত্রে কতটা ‘যৌক্তিক’, সেটি সুযোগ পেলেই প্রকাশ করতে তাদের একেবারে বাধছে না।
এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম না ধরলে পশ্চিমা গণমাধ্যম (সব) একই সুরে কথা বলছে। এই সুরে সুর মিলিয়েছেন পশ্চিমা কিছু বুদ্ধিজীবী। ইউগান হেবারমাস বোধকরি তাদের অন্যতম। খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম, ইংলিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের কিছু সংবাদ দেখে। যেমন, তারা তাদের কার্টুনিস্টকে চাকরিচ্যুত করেছিল স্রেফ নেতানিয়াহুর বিপক্ষে যায় এমন একটি কার্টুন এঁকেছিলেন বলে। পরে অবশ্য পত্রিকাটি ফিরে গেছে ইসরায়েলি গণহত্যার বিপক্ষে। একে খুব স্পষ্ট করেই ‘গণহত্যা’ আখ্যায়িত করেছে। যা পশ্চিমা-ইসরায়েল-মিত্র কোনো পত্রিকা করেনি। ‘গার্ডিয়ান’ কঠোর সমালোচনা করেছে ইউগান হেবারমাস-এর।
পত্রিকাটির বাইরেও বহু একাডেমিশিয়ান এই সমালোচনায় অংশ নেন (রেফারেন্স হিসেবে ইলিনয়েস আরবানা-ক্যাম্পেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আসেফ বায়াতের বক্তব্য দেখা যেতে পারে)। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘নিউ লাইন ম্যাগাজিন’-এ। কিংবা পড়ুন, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক এডাম তুৎজ, ইয়েল ইউনিভার্সিটির আইন ও ইতিহাসের অধ্যাপক স্যামুয়েল ময়ন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও রাজনীতি তত্ত্বের অধ্যাপক অমিয়া শ্রীনিভাসনসহ বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন অধ্যাপক যে চিঠি লিখেছিলেন সেটি [দ্য প্রিন্সিপাল অব হিউম্যান ডিগনিটি মাস্ট অ্যাপ্লাই টু অল পিপল’ শিরোনামে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়] কিংবা পড়ুন হামিদ দেবাশির বক্তব্য [জানুয়ারি ১৮, ২০২৪-এ। এটি প্রকাশিত হয়েছে, ‘থ্যাংকস টু গাজা’ শিরোনামে; মিডল ইস্ট আই)]।
ইউগান হেবারমাস এতকাল তার লেখায় আমাদের জা বলে আসছেন, এবার তিনিই ঠিক উল্টো কাজটি করলেন। পশ্চিমা আলোচনায় যখন হেবারমাস সমালোচিত এবং ইসরায়েলপন্থি পত্রিকাগুলোতে আদৃত, তার কিছু পরে, আন্তর্জাতিক আদালতে উঠল ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিপক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ। তারা অবশ্য হামাসের বিপক্ষেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন।
এই সমমনা পত্রিকাগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করেছে গত মে (২০২৪) মাসের আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিপক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি। এ ব্যাপারে মূল উদ্যোগটি নিয়েছিলেন মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী আমাল ক্লনি। যাকে বিশেষভাবে চিনি তারকা মডেল হিসেবে। এ ক্ষেত্রে তার স্বামী জর্জ ক্লনির প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল বলে পশ্চিমা পত্রিকাগুলো তাকে নিয়েও কিছু সংবাদ তৈরি করে। তবে হলিউড অভিনেতা জর্জ খুব চুপ ছিলেন। একটু বলে নেওয়া দরকার, জর্জ ক্লনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচনে অন্যতম তহবিল সংগ্রাহক। সমালোচনা সেদিক থেকেও হয়েছে।
তবে পত্রিকার নীতি অনুযায়ী। কিন্তু আমি আলাপ করছিলাম, আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিপক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে। বিষয়টি খুব আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের দেশের পত্রিকাগুলো চেপে গেছে কিংবা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হতেও দেখিনি, অন্তত আমাদের পত্রপত্রিকায়। যেন একে তেমন গুরুত্ব না দিলেও চলে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রাশিয়ার পুতিনের বিপক্ষে (১৭ মার্চ ২০২৩) যখন ঠিক একই অভিযোগ আনা হয়েছিল, আমাদের পত্রিকাগুলো খুব উৎসাহের সঙ্গে সে সংবাদ প্রকাশ করেছিল।
আমেরিকা, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশও খুব উৎফুল্ল হয়ে স্বাগত জানিয়েছিল এই সিদ্ধান্তকে এবং তাদের গণমাধ্যম তো বটেই। অনেক ফেসবুক-বিশ্ববোদ্ধা বেশ চমক লাগিয়ে কথাবার্তা বলেছিলেন সে সময় বাংলাদেশে। তারা রাশিয়ার পক্ষেই ছিলেন সবাই। তাদেরও কোনো শোরগোল দেখা গেল না এই ইস্যুতে। কেন? সেই একই কথা, তাদের কাছেও হয়তো বিষয়টিকে গুরুত্বের মনে হয়নি। কিংবা তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পত্রিকা বিষয়টি নিয়ে কিছু লিখেছে, যদিও তা বহু ক্ষেত্রে পশ্চিমা স্বার্থকে সমর্থন করেছে। এটি হতে পারে এ জন্য যে সে দেশের মোদি সরকার পুরোপুরি ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলের গণহত্যাকে মোদি আমলে নিচ্ছেন না। ফলে সে দেশের পত্রিকাগুলো মোদির স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছে, দেশের স্বার্থের সমন্বয়ে। যা পশ্চিমা গণমাধ্যম, যেগুলো আমেরিকা-ইসরায়েলের স্বার্থকে সমর্থন করে, তাদের সমর্থক হিসেবে কাজ করেছে। ইসরায়েলবান্ধব এই গণমাধ্যম মারাত্মকভাবে সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক আদালতে আমালের ওই তৎপরতা।
তারা আন্তর্জাতিক আদালতের সমালোচনা করে। জো বাইডেন তো সোজা বলে দিলেন, হামাস আর ইসরায়েলকে একাকার করে ফেলেছে এই সিদ্ধান্ত। তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি একে। স্বাভাবিক। সেই থেকে নেতানিয়াহুর অবস্থান খুব সহজেই অনুমেয় এবং আশা করি তা নিয়ে লেখার দরকার নেই। তিনি ফিলিস্তিনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার যে সংকল্প করেছেন, তা করেই যাচ্ছেন। আর আমেরিকা যেন এই হত্যাযজ্ঞের চূড়ান্ত দেখতে চায়। সে রকম ছাড়পত্রই তারা দিয়ে রেখেছে ইসরায়েলকে। ফিলিস্তিনের সবাই তার শত্রু।
শিশু, নারী, পুরুষ সবাই। আর ফিলিস্তিনের সবাই সন্ত্রাসী, মানে যে নবজাতকটি নিহত হলো তাদের বোমায়, সেও। আমাদের পাশের দেশ ভারতের পত্রিকার আওয়াজ বহু ক্ষেত্রেই তেমন। মানে মানবতা যায় যাক, তার স্বার্থ টিকে থাকলেই হলো। আমার সঙ্গে কিছু বিদেশি বন্ধুর যোগাযোগ বা আলাপ আছে। ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তাদের অবস্থান মিশ্র। তবে বহু ক্ষেত্রেই তারা তাদের দেশের ইসরায়েল নীতি পছন্দ করছে না। যদিও তাদের সরকার ইসরায়েলকে ফ্রি টিকিট দিয়ে রেখেছে। এখন এই যে পশ্চিমা দেশের ইসরায়েল-মিত্র গণমাধ্যম, এদের এই নীতি কিন্তু নতুন নয়। পশ্চিমা গণমাধ্যম যেমন ঐতিহাসিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়াকে (পরবর্তী সময়ে রাশিয়া) শত্রু হিসেবে তুলে ধরেছে, সে অবস্থান তারা কখনোই বদল করেনি। যেমন করেনি মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে।
ফিলিস্তিন তারই অংশ মাত্র। তাদের নীতি আমরা প্রতিফলিত হতে দেখেছি সোমালিয়ায় (১৯৮০ থেকে ১৯৯০ [কিংবা তার আগে পরেও], লিবিয়ায় [বিশেষত ১৯৮০-এর দশক থেকে এখনো পর্যন্ত], নিকারাগুয়ায় [১৯৮০-এর দশকে], নাফটা [নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট [১৯৯০-এর দশকে] [এই চুক্তির ফলে মেক্সিকো কী মারাত্মক সমস্যায় পড়বে সেটি অনুধাবন করার পরও আমেরিকা সেই চুক্তি থেকে সরে যায়নি। শুধু তার স্বার্থ রক্ষা হবে বলে] এবং কোথায় নয়, কোনো বিষয়ে নয়! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমেরিকা যখনই যেভাবে, যেখানে যা করতে চেয়েছে, পশ্চিমা বহু গণমাধ্যম তাকেই সমর্থন দিয়েছে।
কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়া। ফলে তাদের পক্ষে সরকারি প্রচারণা বা প্রোপাগান্ডা চালানো খুব সহজ হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে ওই সব গণমাধ্যম কোনো ন্যায়নীতির তোয়াক্কা করেনি। আমাদের দেশেও তার প্রভাব খুব লক্ষণীয়। ইসরায়েলি গণহত্যার ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখছি।
ব্যতিক্রম হয়নি। খুব হাস্যকর ব্যাপার হলো, ফিলিস্তিনে আমেরিকা ত্রাণ পাঠানোর ব্যাপারে নমনীয়তা দেখাচ্ছে (অন্তত মুখে বলছে), আবার ইসরায়েলকে তারাই অস্ত্র সরবরাহ করছে। আন্তর্জাতিক আদালতের অবস্থানকে সমালোচনা করছে ইসরায়েল ইস্যুতে। মানবাধিকারের পতাকা তারই হাতে, সেটি বলতেও ছাড়ছে না। আমাদের দেশের গণমাধ্যমের অবস্থান অনেকটা তাদের মতো। এরা অনেকে বহুদিন থেকে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন লিখছে। স্বাধীনতাকামী নয়। হামাস, ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের ইতিহাস না জেনে অথবা বিকৃত করে। আবার চুপ থাকছে বহু ক্ষেত্রে। হতে পারে, যে দেশের সাংবাদিক সমাজ দুর্নীতিবাজদের নিয়ত সেবাদাস/দাসী হয়, তাদের তো ভয় থাকলে চলে না। লজ্জা তো নয়-ই।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়