দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২২ জুন দিল্লিতে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছিলেন। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফর। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড স্পর্শ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বপ্রথম ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত বিকশিত এবং দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প-২০৪১’-এর মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় এখন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জনগণের হাতে। দুই দেশই জনগণের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা বলতে গেলেই অনিবার্যভাবে সর্বপ্রথম একাত্তরের কথা চলে আসে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে।
যুদ্ধের মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা একসঙ্গে মিশে পাকবাহিনীর বিপক্ষে লড়াই করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সম্পর্ককে বাংলাদেশ সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ভারতের অনেক বীর, যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আগত সামরিক শাসক ও তাদের উত্তরসূরি রাজনৈতিক পক্ষের মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পথিমধ্যে সম্পর্ক ততটা এগোতে পারেনি। ২০০৯ সালের পর থেকে আবার দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের সুবাতাস শুরু হয়েছিল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় এসে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘একেবারে একান্ত ভারতের জাতীয় স্বার্থে সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রয়োজন।’
একদম সঠিক কথাই তিনি বলেছেন। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে টেকসই করার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের নৌ, স্থল ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা মানেই বাংলাদেশের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া।
বাণিজ্য, সংযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকে দুই সরকারপ্রধান উভয় দেশের স্বার্থে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল ও সবুজ অংশীদারির জন্য যৌথ দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্মত হয়েছেন। এর আগে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একাধিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে ঢাকা ও নয়াদিল্লি। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও এই দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়েও জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কটা অনেক মজবুত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং যেসব বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, সে বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে এই সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় থাকতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তখন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার যে সহায়তা করেছিল তা বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক রক্ত দিয়ে লেখা। এ সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। এ সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের নয়, এ সম্পর্ক ভাইয়ের সম্পর্ক। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় গেছে তা অনুসরণ করার মতো। এ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
রক্তে লেখা সম্পর্ক অক্ষুণ্ন থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদি ‘মৈত্রী চুক্তির’ মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের যে গোড়াপত্তন করে গেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তা আরও সুসংহত ও বহুমুখী করেছেন। তারই হাত ধরে গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, ট্রানজিট সুবিধা প্রদান ও সমুদ্রসীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের সীমান্ত নীতির ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতির কারণে বাংলাদেশ এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভ্রমণ, ব্যবসা এবং চিকিৎসার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গমন করে তার প্রধানতম প্রবেশদ্বার হচ্ছে বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবুজ অর্থনীতি, পারমাণবিক শক্তি, বিগ ডেটা, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সহযোগিতা স্থাপনে ভারতের রাষ্ট্রপতি জোর দিয়েছেন।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এমন বন্ধনে আবদ্ধ যে এর সঙ্গে অন্য কোনো দেশের সম্পর্কের তুলনা চলে না। আর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ-মায়ানমার উভয় পক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশেরই ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত এবং শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির প্রতি আবেগ প্রায় সমরূপ এবং ওই বিষয়গুলোতে মিল রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়সহ উচ্চপর্যায়ের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। ভারত বাংলাদেশ দুই পক্ষের মধ্যে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বৈঠকের মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, জ্বালানি ও শক্তি এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। উভয় দেশই একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে আমাদের পথ দেখানোর জন্য ‘রূপকল্প ঘোষণা’ অনুমোদন করেছে।
ভবিষ্যতের জন্য ‘ডিজিটাল অংশীদারি’ এবং ‘সবুজ অংশীদারি’বিষয়ক দুটি সমন্বিত রূপকল্প সামনে রেখে কাজ করতে সম্মতি প্রকাশ করেছে দুই দেশ। দুই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক জোরদারে নতুন ৭টিসহ মোট ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সহযোগিতা, রেলওয়ে, দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে সহযোগিতা, মৎস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক বিনিময় করা হয়।
নতুন সাতটি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞান ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যৌথ গবেষণার জন্য বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) এবং ভারতের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (সিএসআইআর) মধ্যে সমঝোতা স্মারক।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল সংযোগ নিয়ে সমঝোতা স্মারক ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ ডিজিটাল পার্টনারশিপ এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সবুজ অংশীদারির বিষয়ে ‘শেয়ার্ড ভিশন’ স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ ভারতীয় রুপিতে লেনদেন শুরু করেছে। ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে যাচ্ছে।
দুই দেশ পদ্মা চুক্তি নবায়নে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের তিস্তা নদীর সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনের জন্যও (ভারতের) একটি কারিগরি দল বাংলাদেশ সফর করবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উভয় দেশকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। তাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপরও নজর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা চালু করবে ভারত।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সুবিধার্থে রংপুরে নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান, আমাদের স্বাধীনতা এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শেষ দ্বিপক্ষীয় সফর করেছিলেন এবং পরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আমন্ত্রিত ‘অতিথি দেশ’ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে নয়াদিল্লিতে ভারতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই একই ‘জুন’ মাসে অভূতপূর্ব দ্বিতীয়বারের মতো নয়াদিল্লি সফর করেছেন।
এর আগে শেখ হাসিনা ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং নবগঠিত মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আরও কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে নয়াদিল্লি সফর করেন। এ সবই সুসম্পর্ক আমাদের এই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সঙ্গে কাজ করার প্রমাণ বহন করে।
লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর