‘বাপুই চেংড়া রে ও মোক গাছত চড়িয়া দুইটা জলপাই পাড়িয়া দে’ কিংবা ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে..’ ইত্যাদি গান শুধু নয়, ‘বাহে’ রংপুর অঞ্চলের ভাষার ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহনকারী একটি নান্দনিক ও ঐতিহ্যবাহী শব্দ। দেশের যেকোনো প্রান্তে কথার ছলে বা কথা বলার সময় কোনো ব্যক্তি যদি এই ‘বাহে’ শব্দটি উচ্চারণ করেন তাহলে তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, ধরেই নেওয়া হয় তিনি রংপুরের মানুষ।
রংপুর অঞ্চলের ভাষার আছে নিজস্ব ঢং-রং। দেও, অ্যালা, মুই, তুই, চেংরা, চেংরি, ওত্তি, এডি, ওডি, কুডি, এইংক্যা, ক্যানে শব্দগুলো সাবলীলভাবে উচ্চারিত হতো নিজস্ব ঢঙে। কিন্তু নিজস্ব ভাষার প্রতি নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ এবং আকাশ সংস্কৃতির আধুনিকতার আঁচ লেগেছে শহর থেকে গ্রামীণ জনপদেও। তাই দিন বদলে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব ভাষা।
রংপুর অঞ্চলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের স্থায়ী বসবাস (বহিরাগতদের চাপ বাড়ছে) হওয়ার কারণে তাদের মুখের ভাষা কোণঠাসা করে ফেলেছে রংপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভাষাকে। আবার কখনো বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষার মিশ্রণে নতুন এক ধরনের শব্দ উচ্চারণের ভাষাচর্চা হচ্ছে। ফলে নিরবচ্ছিন্ন থাকছে না রংপুর অঞ্চলের লোকভাষা।
এ ছাড়া এই ভাষার প্রতি আলাদা ভালোবাসা নিয়েও নতুন করে এগিয়ে আসছেন না সাহিত্যিক, গীতিকার বা নাট্যকাররা। ফলে কথ্য রূপের পাশাপাশি এই ভাষার লিখিত রূপও হুমকির মুখে পড়ছে। ‘মুই তুই, অ্যালা, কোনটে’ এর জায়গা দখলে নিয়েছে আমি, তুমি, কোথায়, এখন।
শিক্ষাবিদ এবং সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই জরুরি। তা না হলে নতুন প্রজন্মের কাছে নিজস্ব ভাষা বলতে আর কিছুই থাকবে না।
একসময় যেকোনো উৎসব-অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বিয়েতে শ্লোক ধরে ঠকানো ছিল জনপ্রিয় সংস্কৃতি। সেটি হারিয়ে গেছে। রংপুর অঞ্চলের সেই সংস্কৃতি এখন অনেকটাই হুমকির মুখে। বিশেষত নতুন করে এ ভাষায় গান, কবিতা, নাটক কিংবা কথাসাহিত্যের চর্চা খুব একটা নেই। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম ছাড়া আঞ্চলিক ভাষায় কথাও বলেন না কেউ।
ভাষা গবেষকরা মনে করেন, এই ভাষা হুমকির মুখে পড়ার অন্য যে কারণ, ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ লোক-ঐতিহ্য লালন, গ্রামীণ লোকগানের চর্চা কমে আসছে রংপুর অঞ্চলে। বাড়ছে বহিরাগতদের চাপ। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল অঞ্চলের নদী-তীরবর্তী মানুষ নদীভাঙনের ফলে রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধায় এসে বসতি গড়ছেন। পূর্বাঞ্চলের লোক ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে নোয়াখালী, কুমিল্লার লোকও রংপুর অঞ্চলে আসছেন, বাসাবাড়ি করছেন। তারা মুখে করে নিয়ে আসছেন তাদের ভাষা। ফলে তাদের ভাষার সঙ্গে রংপুর অঞ্চলের ভাষা মিশ্রিত হচ্ছে।
রংপুরের মাহিগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ওয়াজেদুল ইসলাম রাজু বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের ভাষা ও ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সেগুলো হয় আঞ্চলিক পর্যায়ে। সুনির্দিষ্ট ভাষা পরিকল্পনা গ্রহণ করে আঞ্চলিক ভাষার ঐতিহ্যকে রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।’
রংপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মোনাব্বর হোসেন মনা মনে করেন, ‘আঞ্চলিক শব্দগুলোকে সযত্নে রক্ষা করা দরকার। আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতে ও প্রচারের মাধ্যমগুলো দিয়ে আঞ্চলিক ভাষার শব্দগুলোর প্রচার প্রসার ও সংরক্ষণ করা দরকার আমাদের প্রয়োজনেই। তাহলে নতুন প্রজন্ম আধুনিকতার ভিড়ে নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে ও শিখতে পারবে এবং আয়ত্তে আনতে পারবে।’
রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা মনে করেন, ‘আঞ্চলিকতার যে ঐতিহ্য তা আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে ফেলা ঠিক না। নিজের দায়িত্বে যদি নিজেরা পালন করি, পারিবারিকভাবে কথা বলি তাহলে হামার অঙপুর সুন্দর হবে, সুন্দর থাকবে।’
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা বলেন, ‘আমরা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। এই মাতৃভাষা, মানে বাংলা ভাষা কিন্তু অঞ্চলভেদে রয়েছে। আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনিস্টিটিউট রয়েছে। সেখানে নানা ভাষার বর্ণ রক্ষা করার জন্য একটা গবেষণা চলছে। সে প্রেক্ষিতে বলতে পারি, অঞ্চলভেদে আমাদের মায়ের ভাষা রক্ষা এবং আঞ্চলিক ভাষা বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করা দরকার। এ জন্য আর্ন্তাজিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের শাখা আঞ্চলিক পর্যায়ে বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন।’