![গুলির খবর কারাগারে বসে শুনতে পান অনশনরত শেখ মুজিব](uploads/2024/02/21/1708504210.Bongobandhu.jpg)
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আসে আমাদের স্বাধীনতা। একাত্তরের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিপাগল বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। তবে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ও এর আগে-পরের উত্তাল দিনগুলোতে কেমন কাটছিল তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবের, এ নিয়ে তেমন একটা লেখালেখি হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুর বয়ান থেকেই পাওয়া যায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কারাগারে অনশনরত তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতাদের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের জুলুম-নির্যাতনের চিত্র।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত ‘বায়ান্নর দিনগুলো’তে উঠে আসে ঢাকার কারাগারে অনশন এবং সেখান থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের বর্ণনা। ফরিদপুর কারাগারে নেওয়ার পরের ঘটনা সম্পর্কে ‘বায়ান্নর দিনগুলো’তে উল্লেখ করা হয়েছে, “…তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দুই দিন পর অবস্থা খারাপ হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের দুইজনেরই শরীর খারাপ। মহিউদ্দিন (মহিউদ্দিন আহমদ রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দীর্ঘকাল কারাভোগ করেন। ১৯৭৯-৮১ সময়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা ছিলেন) ভুগছে প্লুরিসিস রোগে, আর আমি ভুগছি নানা রোগে। চার দিন পরে আমাদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। মহাবিপদ! নাকের ভেতর দিয়ে নল পেটের মধ্যে পর্যন্ত দেয়। তারপর নলের মুখে একটা কাপের মতো লাগিয়ে দেয়। একটা ছিদ্রও থাকে। সে কাপের মধ্যে দুধের মতো পাতলা করে খাবার তৈরি করে পেটের ভেতর ঢেলে দেয়। এদের কথা হলো, ‘মরতে দেব না।”’
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রসঙ্গে ‘বায়ান্নর দিনগুলো’তে লেখা আছে, “একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ আরও অনেক স্লোগান। আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ, ফরিদপুর আমার জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোনো স্লোগান দিচ্ছে না কেন? শুধু ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ বললেই তো হতো। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলাম তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম। কত লোক মারা গেছে বলা কষ্টকর। তবে অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে শুনেছি। দুজনে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছি। ডাক্তার সাহেব আমাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু উত্তেজনায় উঠে বসলাম।”
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সময়ের বর্ণনাও পাওয়া যায় ‘বায়ান্নর দিনগুলো’তে। একুশে ফেব্রুয়ারির পরের দিনের বর্ণনায় লেখা আছে, “২২ তারিখে সারা দিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চলল। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এক জায়গায় হলেই স্লোগান দেয়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এল, কিছু কিছু খবর পেলাম। মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন (ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতার ওপর গুলিবর্ষণের জন্য দায়ী তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী) বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হলো মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।
খবরের কাগজে দেখলাম, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন) এমএলএ, খয়রাত হোসেন (আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য) এমএলএ, খান সাহেব ওসমান আলী (নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের তৎকালীন বিশিষ্ট নেতা) এমএলএ এবং মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও খোন্দকার মোশতাক আহমদসহ (১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় ষড়যন্ত্র, গোপন সমর্থন ও সহায়তার জন্য নিন্দিত) শত শত ছাত্র ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। দু-এক দিন পরে দেখলাম কয়েকজন প্রফেসর, মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব ও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভীষণ মারপিট করেছে। বৃদ্ধ খান সাহেব ও তার ছেলেমেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। সমস্ত ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীই বোধহয় আর জেলখানার বাইরে নাই।”