রাজস্ব আদায় বাড়াতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সব পর্যায় ও খাতে ভ্যাটের একক হার (সর্বোচ্চ হার) ১৫ শতাংশ নির্ধারণে জোরালো চাপ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এতে পণ্যের দাম আরও এক ধাপ বেড়ে যাবে- এমন আশঙ্কায় একক হারের পরিবর্তে ভ্যাটের বহুমুখী হারই বহাল রাখলেন অর্থমন্ত্রী আবু হাসান মাহমুদ আলী।
অন্যদিকে বর্তমানে বহাল থাকা কর, ভ্যাট ও শুল্ক অব্যাহতি এবং কর অবকাশের সব সুবিধা বাতিল করে কোনো খাতেই নতুনভাবে আরোপ না করার জন্য আইএমএফ কঠোর থাকলেও তার সবটা মানলেন না। অর্থমন্ত্রী অব্যাহতি ও অবকাশ সুবিধা নতুনভাবে দিলেন না, সব খাতে বাতিল করলেন না, কিছুটা কমালেন। এভাবে আগামী অর্থবছরের জন্য আইএমএফের কিছু শর্ত আসছে বাজেটে বিবেচনা করা হলেও সব মানলেন না অর্থ খাতের এ মন্ত্রী।
বৈঠক নিয়ে এনবিআরের তৈরি খসড়া সারসংক্ষেপ থেকে এসব জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজস্ব বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী সকাল সাড়ে ১০টা থেকে টানা ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট বৈঠক করেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক গোপনীয়তা বজায় রেখে করা হয়। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খানও এ বৈঠকে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেন।
প্রতি অর্থবছর বাজেট প্রস্তাব তৈরির সময় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির (শুল্ক, ভ্যাট ও কর)-এই তিন শাখার কর্মকর্তা এক সঙ্গে উপস্থিত হয়ে বৈঠক করেন। এবারের বৈঠকে তিন শাখার কর্মকর্তারা আলাদাভাবে অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের শুরু থেকেই এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম আইএমএফের প্রস্তাবগুলো জানিয়ে নিজের মতামতও বলেন।
তবে গতকালের এ বৈঠকে বিশেষ ছাড়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া, অর্থপাচার রোধে নেওয়া পদক্ষেপ, পাচারকৃত অর্থ ফেরতে করণীয় নির্ধারণ, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, ন্যূনতম করের হার বাড়ানো, সারচার্জ, বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিকদের ওপর নজরদারিতে পদক্ষেপসহ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নির্ধারণ করার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকের সারসংক্ষেপ থেকে জানা যায়, আইএমএফ থেকে আগামী বছরের বাজেটে ১০ বছর থেকে কর অবকাশ সুবিধা পাওয়া ৩৩টি শিল্প খাতের সুবিধা বাতিল করতে বলেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য যা ভালো তাই বাজেটে আনতে হবে। প্রয়োজনে আরও সময় চেয়ে নিয়ে আইএমএফের প্রস্তাবগুলো সহনীয়ভাবে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। কর অব্যাহতি ও কর অবকাশ সুবিধা প্রায় সব দেশেই আছে। এসব অর্থনৈতিক পলিসি ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা যায়, একবারে না। অব্যাহতি তুলে নেওয়া হলে হঠাৎ করে রাজস্ব বেড়ে যাবে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে উৎপাদনে ধস নামবে। তাই একসঙ্গে সবকিছু মানা যাবে না।
তবে এনবিআরকে এখনই ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার কাজ শুরু করতে হবে। নীতিগত সহায়তার ক্ষেত্রে এনবিআর এক জায়গায় স্থির থাকবে না।
আইএমএফ থেকে তৈরি পোশাক, প্রযুক্তি ও জ্বালানি খাতে রাজস্ব সুবিধা বাতিলে চাপ দেওয়া হলেও অর্থমন্ত্রী আসন্ন বাজেটে তা কার্যকরের অনুমতি দেননি। তবে জ্বালানি খাতে সুবিধা কিছুটা কমাতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের কর্মকর্তারা ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণের পক্ষেই কথা বলেন। তারা বলেন- সিগারেট, টেলিফোন, মোবাইলফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পেট্রোলিয়াম পণ্য, সিমেন্ট খাত থেকে মোট ভ্যাটের বড় অংশ আসে। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবং ডলারসংকটের কারণে অনেক খাতের অবস্থা ভালো নয়। তাই এসব খাতে ভ্যাট আদায় কমে গিয়েছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে দুই অর্থবছর কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়াতে হবে।
আইএমএফ ভ্যাট থেকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভ্যাট থেকে ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা আদায় করার কথা বলেছে।
বৈঠকে আরও বলা হয়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে আদায় বাড়বে।
অর্থমন্ত্রী এনবিআরের এ যুক্তি বিবেচনায় না নিয়ে বলেন, ভ্যাটের হার বাড়ানো হলে অনেক জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ পড়বে। যা ঠিক হবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঋণ নিলে দাতা সংস্থা থেকে বিভিন্ন শর্ত মানার চাপ থাকবে। তবে তার সবটা মানা হলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে। তাই সরকারের সব দিক বিবেচনা করে বাজেট দিতে হবে।’
ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন থেকে উৎসে করের হার কমানোর দাবি করে এলেও আগামী বাজেটেও অর্থমন্ত্রী তা বহাল রাখলেন, কমালেন না। তবে শিল্পে বেশি ব্যবহার হয় এমন সব কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমালেন। অনেক কাঁচামালের শুল্ক মওকুফ করলেন। দেশি শিল্পের বিকাশে গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয়ভাবে এসি, ফ্রিজ ও মোটরসাইকেল উৎপাদনে সুবিধা বহাল রাখলেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও আমদানিতে ছাড় দিলেন। মাছ চাষ, পশুর খামারে সুবিধা বাড়ালেন। এইচএসকোডের জটিলতা নিরসনে নির্দেশ দিয়েছেন।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো যায় কি না তা আবারও এনবিআরকে ভেবে দেখতে বলেছেন অর্থমন্ত্রী। রাজস্ব জালের আওতা বাড়াতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে এনবিআরের যুক্তি মানেননি তিনি। বর্তমানে যা আছে তার থেকে প্রবৃদ্ধি ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ বাড়ানো উচিত বলে মত দিয়েছেন।
তবে এনবিআর কর্মকর্তারা এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা এনবিআরের বর্তমান অবকাঠামো এবং লোকবলে সম্ভব না বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন। বিষয়টি অমীমাংসিত রয়েছে। অর্থমন্ত্রী এনবিআরের অবকাঠামো শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। রাজস্ব আদায়ে এবং রাজস্ব সম্পর্কিত কাজে ই-পেমেন্ট ও অন লাইনে জোর দিলেন। এনবিআরের লোকবল বাড়াতেও বলেছেন মন্ত্রী। অমীমাংসিত রাজস্ব মামলা নিষ্পত্তিতে নতুন কৌশল নিতে বলেছেন। তবে কমালেন না এনবিআর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা। এনবিআর কর্মকর্তাদের আপত্তি সত্ত্বেও বিদেশ যাওয়ার আগে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের হিসাব জানিয়ে যাওয়ার বিধান বহাল রাখলেন।