সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহে মাঠে নেমেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা। তারা গোপনে ঢাকা, চাঁদপুর সদর ও মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গোপনে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। গোয়েন্দা সদস্যরা মূলত আজিজের অবৈধ সম্পদ, অর্থপাচারসহ তার ভাইদের আর্থিক দুর্নীতি, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট জালিয়াতির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। এ বিষয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের গোয়েন্দা টিম কাজ করছে।
এদিকে, আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ আমলযোগ্য কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক)। বিশেষ করে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় আসা প্রতিবেদন এবং একজন আইনজীবীর দেওয়া অভিযাগপত্রের তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাবাকের সুপারিশ ও গোয়েন্দা টিমের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। এ ব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগটি যাচাই করে দেখা হবে সেটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে কি না। অভিযোগ আমলযোগ্য হলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অভিযোগটি যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
দুদকের কর্মকর্তারা খবরের কাগজকে জানান, সাধারণত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের অনুসন্ধান শুরুর আগে দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে গোপনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত ও যাবাকের সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশন অনুসন্ধান শুরু করার নির্দেশ দিয়ে থাকে। কমিশন অনুমোদন দিলে অনুসন্ধানের জন্য পৃথক কমিটি গঠন করা হয় এবং সেই কমিটি প্রকাশ্যে অনুসন্ধান শুরু করে। প্রকাশ্যে অনুসন্ধানই মূলত দুদকের মূল অনুসন্ধান। আজিজ আহমেদের ক্ষেত্রে তেমনটাই হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। আগে এ ধরনের তথ্য সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাসখানেক সময় পাওয়া যেত। কিন্তু এবার এই সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আগামী ১৫ জুনের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করার তাগিদ রয়েছে।
গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান দুদকের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাহিদ।
এই টিমের অন্যতম সদস্য হলেন- মানিলন্ডারিং শাখার পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী, বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানবিষয়ক শাখার উপ-পরিচালক ফারুক আহমেদ, বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-৩-এর উপ-পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি, উপ-পরিচালক মো. নাজমুল হুসাইন, উপ-পরিচালক তানজির হাসিব সরকার ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকী। প্রয়োজন হলে আরও কর্মকর্তাকে এই টিমে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর সেনাপ্রধান ছিলেন আজিজ আহমেদ। ২০১২ সাল থেকে চার বছর সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেনাপ্রধান থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিকে অবসরের পর গত ২০ মে ‘তাৎপর্যপূর্ণ দুর্নীতিতে’ জড়িত থাকার অভিযোগে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয় যুক্তরাষ্ট্র।
দুর্নীতি ছাড়াও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ২০১৪ সালে তার ভাই হারিছ আহমেদকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেন। ওই ছবি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিলেন জেনারেল আজিজ। জেনারেল আজিজ ২০১৯ সালে নিজের এনআইডিতেও ছবি পরিবর্তন করেন। তার আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফের নামে নিয়েছেন দুটি এনআইডি। এর একটি তানভির আহমেদ তানজীল নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা হয়েছে। অন্যটি নিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ জোসেফ নামে। তার তিন ভাই হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। এ ছাড়া আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আজিজের অবৈধ সম্পদের তদন্ত চেয়ে গত বুধবার দুদকে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। আবেদনে বলা হয়, দুর্নীতির অভিযোগে জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনেও দেশের সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে প্রচণ্ডভাবে। দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। দুদক এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা না নিলে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হবে।