সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ফুটবল দলের মাঠের খেলায় এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। যার সুবাদে মাস পাঁচেক আগে ১৪ বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ মিলেছিল। ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইয়েও ভালো খেলার সেই ধারা বজায় রেখেছে হাভিয়ের কাবরেরার দল। তবে বিশ্লেষকরা বললেন, আরও সুন্দর ফুটবল খেলতে হবে বাংলাদেশকে।
কিংবদন্তি স্ট্রাইকার শেখ মোহাম্মদ আসলাম ফুটবলারদের মনোভাবের যে পরিবর্তন এসেছে তার প্রশংসা করলেন। তার মতে, ‘আরও অর্গানাইজড ফুটবল খেলতে হবে।’ আর জাতীয় দলের সাবেক কোচ মারুফুল হকের কাছে ফুটবলারদের সাইকোলজিক্যাল পরিবর্তনটা দৃশ্যমান। তবে তিনিও উন্নতির জায়গা দেখছেন অনেক। সেই সঙ্গে বর্তমান যে পরিবর্তন, সেটা ধরে রাখাকেও বেশি জরুরি বলে মনে করছেন তিনি।
মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রাক-বাছাই পর্বের বাধা ডিঙিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে দুটি ম্যাচ খেলে ফেলল জামাল ভূঁইয়ারা। গত ১৬ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ০-৭ গোলে বিধ্বস্ত হলেও ২১ নভেম্বর ঘরের মাঠে লেবাননকে ১-১ গোলে রুখে দিয়েছেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। যদিও ৭৯ ধাপ এগিয়ে থাকা লেবাননের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়টাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি গোলের বেশ কিছু সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায়। পিছিয়ে পড়েও শেখ মোরসালিনের দৃষ্টিনন্দন এক গোলে ম্যাচটা ড্র করে বাংলাদেশ। তবে মোরসালিন নিজেই গোলটির আগে ও পরে সুযোগ হাতছাড়া করেছেন বেশ কয়েকটি। সুযোগ হারিয়েছেন বিশ্বনাথ ঘোষ, সোহেল রানা, ফয়সাল আহমেদ ফাহিমরাও।
মারুফুল মনে করেন, ম্যাচটা জেতা উচিত ছিল বাংলাদেশের, ‘মাঠের খেলা অনুসারে বলব, অবশ্যই লেবানন ম্যাচটা বাংলাদেশের জেতা উচিত ছিল। সুযোগও ছিল জেতার।’ কিন্তু বাংলাদেশ কেন জিততে পারল না? এই প্রশ্নে সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টিই আসবে সবার আগে। শেখ মোহাম্মদ আসলামের দৃষ্টিতে এখানে ঘাটতি বেশ বড়, ‘আমাদের সময় স্কোরিং অ্যাবিলিটি যেটা ছিল, জায়গামতো বল পেলে গোল হওয়ার নিশ্চয়তা থাকত। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষদের যে আস্থা, এই জায়গাটায় একটু সময় লাগছে। তবে আশা করি দল এটা ওভারকাম করবে।’
আসলাম মিডফিল্ড ও রক্ষণেও বেশ দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন, ‘এমন জায়গায় ওরা বলগুলো হারায়, যেটা দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। ডিফেন্স ও মিডফিল্ডের যে জায়গাগুলো আছে, এখানে আরও অর্গানাইজড হতে হবে। আমি বলব, ডিফেন্স লাইন খুব ডিসঅর্গানাইজড ওয়েতে ফুটবল খেলে। আরও সুন্দর ফুটবল খেলা উচিত।’ বিশ্বের বড় দলগুলোর উদাহরণ টেনে তিনি যোগ করেন, ‘ওদের খেলোয়াড়দের কাছে যখন বল যায়, মনে হয় আস্থার স্থল। ওখান থেকে মিস পাস হবে না। কিংবা সুন্দর পাস হবে, যা থেকে গোল হতে পারে। এগুলো আসলে ম্যাচিউরিটির ব্যাপারও। একটু সময় লাগবে। এই সময়টা আমাদের খেলোয়াড়দের দিতে হবে।’
দুর্বলতা দেখছেন মারুফুলও। তবে তার আগে দলের উন্নতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ভালো খেলছে। ওভারঅল পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে বললে বলব, ফুটবলারদের সাইকোলজিক্যাল পরিবর্তন এসেছে। খেললে প্ল্যান অনুযায়ী খেলা যায়, এই মনোভাবটা এসেছে। সেই সঙ্গে দলের আত্মবিশ্বাসও এসেছে। খেলার চেষ্টা করতেছে, এটাই হচ্ছে বড় কথা। আসলে ফুটবল তো যতটা না পায়ের খেলা, তারচেয়ে বেশি হলো মাথার খেলা। খেলোয়াড়রা তাদের মাথা ব্যবহার করতে পারছে।’ তবে দেশের অন্যতম সেরা এই কোচ উন্নতিটা ধরে রাখা জরুরি বলে মনে করেন, ‘দলটা ৮-৯ মাস ধরে ভালো করছে। এটা ধরে রাখতে হবে। এটা ধরে রাখতে পারলে বোঝা যাবে যে স্থায়ী পরিবর্তন এসেছে। কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে খেলোয়াড়, সবাই চেষ্টা করছে। এটা যদি মেইন্টেন করতে পারে, তখনই বোঝা যাবে পরিবর্তন হয়েছে।’
কোন জায়গায় ঘাটতি দেখছেন বা আরও উন্নতি প্রয়োজন? এমন প্রশ্নের মারুফুলের উত্তর, ‘বাংলাদেশের জাতীয় দল নিয়ে কাজ করার বা উন্নতি করার ক্ষেত্র অনেক। কঠিন পরিস্থিতিতে বল হোল্ড করা এবং সাপোর্টিং খেলোয়াড়দের বলের কাছাকাছি আসা, কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কী হবে, এই বিষয়টা নিয়ে আরও ক্লিয়ার থাকতে হবে। নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আমরা প্ল্যান অনুযায়ী খেলে গোলের সুযোগ তৈরি করে গোল করব, সুযোগ আসতে পারে, সেটার জন্য তৈরি থাকতে হবে।’
জাতীয় দলের আরেক সাবেক ফুটবলার ও কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক ফুটবলারদের খেলায় বেশ খুশি, ‘ফুটবলাররা মনের দিক থেকে অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা হারার আগে হারি না, এই জিনিসটা ফুটবলাররা গত কয়েক মাস ধরে প্রমাণ করতে পেরেছে। এটাই বর্তমান দল ও কোচের সাফল্য বলে মনে করি। আর এই ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত আছে এবং আশা করি এটা বজায় থাকবে।’
গোল মিস নিয়েও খুব বেশি চিন্তিত নন মানিক। তার মতে এটা খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে মানিক মনে করেন, ‘বর্তমান দলটায় খুব হাই কোয়ালিটির খেলোয়াড় আমরা পেয়েছি, এমন নয়। তবে সবাই খুব কাছাকাছি। কারও রিপ্লেস নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। এটাই হোক। অনেক খেলোয়াড় থাকুক।’
তবে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন মানিক। সেটা হচ্ছে ডিসিপ্লিন। মানিক বলেন, ‘এটা বসুন্ধরা কিংস বা ফেডারেশন যে করুক না কেন, ডিসিপ্লিনটা খুব শক্তভাবে হ্যান্ডেল করেছে তারা। এই জায়গায় আমাদের গুরুত্ব আরও বেশি দেওয়া উচিত। অতীতে দেইনি বলে আমরা অনেক পিছিয়েছি। শুধু জাতীয় দল না, ক্লাব ফুটবলেও এই দিকটায় নজর দেওয়া উচিত।’