সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। চলে তার আপন গতিতে। এইতো খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে জাগরণ আনতে আইসিসি শুরু করেছিল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পথচলার দ্রুততম সময়ে তারা আয়োজন করেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০০৭ সালে প্রথম আসর বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকাতে। প্রথম আসরেই বাংলাদেশ বাজিমাত করেছিল সুপার এইটে খেলে। কিন্তু এরপর, এরপর আর সুপার এইটের দেখা মেলেনি। এভাবে কেটে যায় ১৭ বছর। অবশেষে দীর্ঘ ১৭ বছর পর আবার সেই অঙ্গনে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নবম আসরে বাংলাদেশ সুপার এইটে খেলার ছাড়পত্র পেয়েছে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের জন্য আনন্দ-বেদনার এক মিশ্র অনুভূতি। জয় দিয়ে শুরু করেছিল। ২০০৬ সালে খুলনায় শাহরিয়ার নাফিসের নেতৃত্বে জিম্বাবুয়েকে হারিয়েছিল ৪১ রানে। পরের ম্যাচেও জয় এসেছিল কেনিয়ার বিপক্ষে ৫ উইকেটে। পাকিস্তানের কাছে তৃতীয় ম্যাচে হেরেছিল ৩০ রানে। এই তিনটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেখানে গ্রুপ পর্বে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকা। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬ উইকেটে হারিয়ে বাজিমাত করে বাংলাদেশ। এক জয়েই তারা পৌঁছে যায় সুপার এইটে। এটি সম্ভব হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে যাওয়াতে। দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে বাংলাদেশ হেরে যায় দ্বিতীয় ম্যাচে। সুপার এইটে গিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে। কিন্তু কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি। কিন্তু তারপরও সবার মনে হয়েছিল ছোট ফরম্যাটের ক্রিকেটটাকে বাংলাদেশ বেশ ভালোই রপ্ত করেছে। কিন্তু সবই ছিল ভুল ধারণা। এ সবই ছিল ক্ষণিকের সাফল্য। এরপরই বের হয়ে আসে বাংলাদেশ দলের প্রকৃত চিত্র। যে চিত্র ছিল খুবই ভয়াবহ। সর্বত্রই ব্যর্থতা। জয় হয়ে উঠে সোনার হরিণ। ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে জয় পেয়েছিল, সেখানে পরের জয় আসে চার বছর পর ২০১১ সালে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই মিরপুরে। এরপর থেকে এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পথ চলা। ধারাবাহিক হতে পারেনি কখনো। মাঝে মধ্যে আসে এক একটি জয়!
এই পথ চলায় সবচেয়ে বিব্রতকর ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০০৭ সালে যে আসর শুরু হয়েছিল মাঝে মাঝে ছন্দপতন ছাড়া প্রতি দুই বছর পরপর তা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকার কারণে বাংলাদেশকে প্রাথমিক রাউন্ড খেলে আসতে হয়েছে। কখনো কখনো এই প্রাথমিক রাউন্ড পাড়ি দিতেও গলদঘর্ম হয়েছে। কখনো মূল পর্বে যাওয়া বাদ না পড়লেও সুপার এইটে যাওয়া হয়নি। প্রাথমিক রাউন্ডের গণ্ডি পার হয়ে মূল পর্বে গেলেও সুপার এইটে যাওয়া দূরে থাক, জয়ই হয়ে উঠে আকাশের চাঁদ। এভাবে একটি করে আসর যায়, আর বাংলাদেশের অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে। কিন্তু অপেক্ষা আর ফুরোয় না। অবশেষে সেই অপেক্ষার প্রহর কেটেছে এবারের আসরে।
এবার যে বাংলাদেশ সুপার এইটে খেলবে, এমন ভাবনার লোক খুঁজতে গেলে হয়তো পাওয়া দুষ্কর হবে। কারণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আসার আগে দলের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও দেশ ছাড়ার আগে কোনো রকম প্রত্যাশা করতে না করেছিলেন। সুপার এইটে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দুই দলের যে কোনো এক দলকে হারাতে পারলে বাংলাদেশের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। সেই দুয়ার বাংলাদেশ খুলে শ্রীলঙ্কাকে লো-স্কোরিং ম্যাচে ২ উইকেট হারিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আরেকটি লো-স্কোরিং ম্যাচে জিততে জিততেও পরে বাংলাদেশ হেরে যায় ৪ রানে। বাকি থাকে শেষ দুই ম্যাচে নেদারল্যান্ডস ও নেপালকে হারানো। এই কাজটি বাংলাদেশ করে ভালো-মন্দের মিশেলে। নেদারল্যান্ডসকে ২৫ ও নেপালকে ২১ রানে হারানোর মাঝে মনে হবে বাংলাদেশ সহজেই পার পেয়ে গেছে। কিন্তু আসলে তা নয়। নেদারল্যান্ডসকে সহজে হারালেও নেপালকে হারাতে ঘাম ছুটেছে। মাত্র ১০৬ রান করার পর বোলারদের অসম্ভব ভালো বোলিং বাংলাদেশকে ১৭ বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো সুপার এইটে খেলার সুযোগ করে দেয়।
২০০৭ সালের পর ২০২৪ সাল। প্রথম আসরে বাংলাদেশ সুপার এইটে খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেখানে পায়নি কোনো জয়। এবার খেলবে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে। প্রতিটি দলই শক্তিশালী। প্রথম দুই দল একবার করে শিরোপা জিতেছে। আর আফগানিস্তানতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাজিমাত করা এক দল। ব্যাটিং ব্যর্থতার যে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বাংলাদেশ সুপার এইটে গিয়েছে। তা থেকে মুক্তি না পেলে ১৭ বছর পর খেলা সুপার এইটে ফিরে আসতে পারে ২০০৭ সালেরই স্মৃতি!