দরজা কড়া নাড়ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ ১৪৩১। অতীত জরা-গ্লানি ঘুচে নতুন আশায় কায়মনে অগ্নিস্নানে ধরা শুচি হয়ে উঠুক, এমন প্রত্যাশায় বর্ষবরণকে ঘিরে বাঙালির আয়োজনে কমতি থাকে না। বাঙালির কৃষ্টিতে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা যেন বরাবরই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, বিগত বছরগুলোর মতো এবারও চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাতে আয়োজনের ব্যত্যয় ঘটেনি। চারুকলা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দিন-রাত এক করে জোরেশোরে চালিয়ে নিচ্ছেন মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্বের কাজ।
শুক্রবার (২৯ মার্চ) বন্ধের দিন হওয়ার পরও পুরোদমে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞে বিভোর ছিলেন সংশ্লিষ্টরা। একদিকে বিভিন্ন প্রতিকৃতিতে শিক্ষার্থীদের নানা দিকনির্দেশনায় চাটাই বুনছেন নির্মাণশ্রমিকরা। অন্যদিকে কেউবা রং-তুলি হাতে নিয়ে পাখি, সরা, মাটির জিনিসপত্র, মুখোশে বদহারি রঙে রাঙিয়ে তুলছেন। আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর তৈরি এসব জিনিসপত্র বিক্রির জন্য পসরা সাজিয়ে বসেছেন শিক্ষার্থীরা।
এ বছর অনুষদের ২৫তম ব্যাচ দায়িত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন মোটিভে সজ্জিত থাকছে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা। টেপা পুতুল, হাতি, গন্ধগোকুল, চাকার একটি ডেকোরেটিভ ডিজাইন এবারের শোভাযাত্রায় এই চার স্ট্রাকচার স্থান পেতে যাচ্ছে।
কথা হয় প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিত সাদমান রাহাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রোজা ও ঈদের ছুটিতে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞে উপস্থিতি তুলনামূলক কম। এর পরও আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করে চলছি। বিগত বছরগুলোর মতো আয়োজনে কোনো কমতি থাকবে না। আশা করছি, এ বছরও জাঁকজমকপূর্ণভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।’
পুরো আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তৈরি সরা, মুখোশ ও পেইটিং বিক্রি করে শোভাযাত্রার খরচ বহন করা হয়। এ বছর আনুমানিক ১২ লাখ টাকা বাজেট ধরা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাদিত সাদমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একধরনের বাজেট দেওয়া হয়। কিন্তু এটি অনেকটাই অপ্রতুল। তবে সব মিলিয়ে যে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে, এর মধ্যেই সবকিছু সম্পন্ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।’
শোভাযাত্রার প্রস্তুতির কারণে অনেক শিক্ষার্থীই ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন না। তাদের একজন প্রিন্টমেকিং বিভাগের শিক্ষার্থী জাবির জামান। তিনি বলেন, ‘আমরা গত বছর থেকেই বিষয়টি অবগত। তারপরেও এটি তো আমাদের ব্যাচের বৈশাখ, এটি তো আমাদের করতে হবে, আবার সেভাবে কাজ না করলে হয়তো বিগত বছরগুলোর মতো শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে না। তাই আমরা অনেকেই ছুটিতে বাড়িতে যাচ্ছি না।’ আগামী এক সপ্তাহে মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি বড় অংশের প্রস্তুতি শেষ হবে বলে জানান তিনি।
প্রিন্টমেকিং বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী পূজা রায় বলেন, ‘২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার আমাদের ব্যাচ দায়িত্ব পেয়েছে। যেহেতু আমাদের সময় কম, তাই কষ্ট একটু বেশি হচ্ছে, এরপরও কাজটি বেশ উপভোগ করছি।’
সার্বিক বিষয়ে কথা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা উপকমিটির আহ্বায়ক চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শোভাযাত্রার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলবে। রোজা আমাদের আয়োজনে বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি। কেননা, এর আগেও ছেলেমেয়েরা রোজা রেখে কাজ করে গেছে। কিন্তু ঈদের ছুটি হওয়াতে অনেকেই চলে যাবে। তবে ঢাকায় যেসব শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের নিয়েই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যেন এবারের শোভাযাত্রাও বড় পরিসরে করা যায়।’
চলতি বছরে শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’ কবিতা থেকে ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ বাক্যটি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে বরাবরই তরুণরা একটি বার্তা দেয়। সেই বার্তাটি হলো আমরা তিমির বিনাশী, আমরা অন্ধকারের বিপক্ষে, আলোর পক্ষে। এ ছাড়া কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা, উগ্রতা থেকে মুক্তির আহ্বান থাকে।’
এদিকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন এই কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নববর্ষ উদযাপনে দুটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে শৃঙ্খলা উপকমিটি ও মঙ্গল শোভাযাত্রা উপকমিটি।
স্বৈর-সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একই সঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। ওই বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখেন। ১৯৯৬ সালে থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। ২০১৬ সালে ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেসকোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।