তীব্র গরমে মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকুলেও হাঁসফাঁস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রোদের খরতাপে অতিষ্ঠ হয়ে বারবার পুকুর, ডোবা, খাল, নদীসহ বিভিন্ন জলাধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শরীর ডুবিয়ে রাখছে প্রাণীরা। বিশেষ করে বেকায়দায় পড়েছে মাংসাশী প্রাণীরা। কোনো কোনো প্রাণী পানিতে মুখ ডুবিয়ে একটু স্বস্তি নেওয়ার চেষ্টা করছে। এরপর ছুটে যাচ্ছে হালকা শীতল পরিবেশের খোঁজে, গাছের ছায়ায়। অনেক প্রাণী আবার গরমে অসহ্য হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পিপাসায় কাতর হয়ে পানির সন্ধানে উড়ছে পাখির দল। এসব কারণে চিড়িয়াখানাসহ বিভিন্ন খামার মালিকদের নিতে হচ্ছে বাড়তি যত্ন।
শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) চট্টগ্রাম নগরের চিড়িয়াখানা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা এবং ডেইরি খামার ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা যায়, বাঘ, সিংহ, ভালুক খাঁচার ভেতরে জলাধারে শরীর ডুবিয়ে রেখেছে। সিংহগুলো বারবার পানিতে ডুব দিয়ে খাঁচার ভেতরের অপেক্ষাকৃত ছায়াযুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। একইভাবে বাঘ দম্পতি তার সন্তানদের নিয়ে পানিতে ডুবে আছে।
চিড়িয়াখানার জলহস্তি দুটি জলাধারে ডুবে আছে, মুখের সামনের অংশ উঁচু করে কিছুক্ষণ পরপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। একই অবস্থা ভালুক ও কুমিরেরও। হরিণের দল গাছের ছায়ায় জড়ো হয়ে আছে। পাখিগুলো পিপাসায় কাতর হয়ে পানি পান করছে। গুইসাপটি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে গরমে। বানর, মুখপোড়া হনুমান, মদনটাক, টিয়া পাখিগুলো নীরব হয়ে আছে। কোনো চঞ্চলতা নেই তাদের মাঝে।
তবে কেবল চিড়িয়াখানা নয়, এই গরমে অতিষ্ঠ হতে দেখা গেছে নগরের আশপাশের এলাকার প্রাণিকুলকেও। শুক্রবার দুপুরে নগরের কর্ণফুলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদী ও পাশের কয়েকটি জলাধারে মহিষের পাল পানিতে ডুবে আছে।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা আব্দুল বারেক খবরের কাগজকে জানান, শুক্রবার চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন রেকর্ড করা হয়েছে ২৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে প্রচণ্ড গরমের কারণে প্রাণিকুলে অস্বস্তি চিন্তায় ফেলেছে খামার মালিকদের। প্রতিদিন গরু, ছাগল, মহিষ, মুরগির বাড়তি যত্ন নিতে হচ্ছে তাদের।
সীতাকুণ্ডের খামারি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘৮০০ মুরগির একটি শেডে ছয়টি ফ্যান লাগাতে হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি গরুর জন্য তিনটি ফ্যান বসানো হয়েছে। এরপরও গরুগুলো গরমে হাঁসফাঁস করছে। দিনে অন্তত চারবার গোসল করাতে হচ্ছে। স্যালাইন, নিরাপদ খাবার পানি খাওয়ানো হচ্ছে। শরীরে গরম কমাতে বিশেষ ওষুধও খাওয়াতে হচ্ছে।’
বাঁশখালী উপজেলার হাজি এগ্রোর মালিক ফজল করিম বলেন, ‘গরমে গরুগুলো নিমোনিয়া ও ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বারবার গোসল করাতে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে নজরে রাখতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে।’
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, ‘তীব্র গরমে প্রাণীদের অবস্থা কাহিল। প্রতিনিয়ত তাদের বাড়তি খেয়াল রাখতে হচ্ছে। পানি শূন্যতা দূর করতে বারবার খাবার স্যালাইন ও পানি খাওয়ানো হচ্ছে। ইলেকট্রোলাইট দেওয়া হচ্ছে। শরীর শীতল করার জন্য ভিটামিন-সি খাওয়ানো হচ্ছে। কোনো প্রাণী যেন হিট স্ট্রোক না করে সে জন্য আমরা সব সময় নজরে রাখছি। গরমে এই বাড়তি উদ্যোগ আমাদের নিতে হয়। গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক্সট্রা কেয়ারের এই প্রক্রিয়া শুরু হয় চিড়িয়াখানায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাংসাশী প্রাণীগুলো বেশি ঝুঁকিতে আছে। সে জন্য আমরা গরমে মাংসের পরিমাণও কিছুটা কমিয়ে দিই। নিয়মিত খাঁচার ভেতরে জলাধারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি দেওয়া হচ্ছে। বাঘ, ভালুক, সিংহরা কিছুক্ষণ পরপর এ পানিতে নেমে পড়ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আরাম করছে। তারা নিজেরাই বুঝে গরমে কী করতে হবে। আমরা শুধু পানির ব্যবস্থা করে দিই। পাখিরাও গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তাদেরও স্যালেইন খেতে দেওয়া হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ও হোমল্যান্ড ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মালিক মোহাম্মদ ওমর বলেন, ‘আমার খামারে ২০০টির বেশি ফ্রিজিয়ান জাতের গরু আছে। তীব্র গরমে এই গরুগুলোর সার্বক্ষণিক যত্ন নিতে হচ্ছে। মাঠের গরুগুলোকে দুপুর ১১টার আগেই ঘরে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এরপর স্যালাইন, নিরাপদ খাবার পানি দিতে হচ্ছে।’