![অবশেষে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ডলার ছাড় দিল আইএমএফ](uploads/2023/12/13/1702408070.1697726481.imfkk.jpg)
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশে চলমান দুটি ঋণ কর্মসূচির আওতায় দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮১ মিলিয়ন (৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার) অবশেষে ছাড় দিয়েছে। মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত আইএমএফ বোর্ডসভায় এ অর্থ ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। এক বিবৃতিতে আইএমএফ এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কাজী তৌহিদুল ইসলাম সিজার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বরাত দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আইএমএফের দেওয়া শর্তাবলিগুলো ঠিকমতো পরিপালন না হওয়ায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি। অবশেষে আইএমএফ পর্ষদ সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ছাড় হলো এ অর্থ।
এ অর্থ সাময়িকভাবে বাংলাদেশের চলমান বৈদেশিক মুদ্রাসংকট কাটাতে কাজে লাগবে বলে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেছেন। তিনি বলেন, সাময়িক সময়ের জন্য রিজার্ভ একটু চাঙা হবে ও বিনিময় হারে চলমান অস্থিরতাও কমবে। তবে সংকট উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার ও বৈদেশিক সম্পদের বিকল্প নেই। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ও পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার, বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড়, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয়ের প্রত্যাবাসন ঠিকমতো হতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তীব্র হওয়ায় বাংলাদেশ রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করার ফলে রিজার্ভে আইএমএফের দেওয়া সীমা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ আরও কম।
তবে চলতি অর্থবছরে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন কার্যক্রমও জোরদার করা হবে। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণ বিতরণ বাড়লে রিজার্ভও ধারাবাহিকভাবে বাড়বে। এমন প্রতিশ্রুতি ও প্রক্ষেপণ থেকে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় দেওয়ার ব্যপারে ইতিবাচক প্রতিবেদন পর্ষদ সভায় দাখিল করে।
বাংলাদেশের জন্য আইএমএফ গত জানুয়ারিতে দুটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। একটি এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) বা এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির (ইইএফ) আওতায় বরাদ্দকৃত ঋণের পরিমাণ ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অপরটি হলো রেসিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)। এর আওতায় ঋণের পরিমাণ ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। মোট ঋণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলার। মোট ৪২ মাস সময়ে এ ঋণ বিতরণ করার কথা। প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন বা ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার আসে গত ফেব্রুয়ারিতে। শিডিউল অনুযায়ী দুটি ঋণ কর্মসূচি থেকে ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হওয়ার কথা ছিল।
আইএমএফ বলেছে, সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বৈশ্বিক চাপের প্রভাবে টাকা-ডলার বিনিময় মূল্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
গত অক্টোবরে দুই সপ্তাহব্যাপী ‘স্টাফ ভিজিট’ শেষে আইএমএফ ঢাকায় এক বিবৃতিতে তাদের এ মূল্যায়নের কথা জানায়। এ মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের পরবর্তী (দ্বিতীয়) কিস্তি ডিসেম্বরে ছাড়ের ব্যাপারে আশাব্যঞ্জক দিক উন্মোচিত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আইএমএফ স্টাফ মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দ বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আইএমএফ-সমর্থিত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি রয়েই গেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অব্যাহত সংকোচন ও একই সময়ে সৃষ্ট ও বিরাজিত দুর্বলতাগুলোর কারণে বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করেছে। এর প্রকাশ ঘটেছে বৈদেশিক মুদ্রাসংকট ও ডলার-টাকার বিনিময় মূল্যের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক উদ্যোগগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। এতে আগামী জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশই হবে। এ ছাড়া বিনিময় হারে নমনীয়তার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চার মাসের আমাদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা তৈরি হবে বাংলাদেশের।
মোট ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে ছাড় করার অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ঋণ কর্মসূচিতে ৩০টি শর্ত রয়েছে। এসব শর্তাবলি সরকারের ৩টি বিভাগের অধীনে পড়ে।
এক. গুণগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত (কিউপিসি), দুই. অবকাঠামোগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত (এসপিসি) ও তিন. সাধারণ প্রতিশ্রুতি।
কিউপিসির আওতায় শর্তের মধ্যে রয়েছে নেট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের একটি ন্যূনতম স্তর নির্ধারণ এবং সরকারের বাজেট ঘাটতির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ।
অন্যান্য শর্তাবলির মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা, আদায়ের অযোগ্য ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, জ্বালানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ফর্মুলা কার্যকর করা, আয়কর আইন সংসদে পাস করা, করছাড়ের ওপর বিস্তারিত নিরীক্ষা করা এবং বাজেটে সামাজিক ব্যয়ের (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি) পরিমাণ ক্রমেই বাড়ানো।
আইএমএফ বিবৃতিতে রাজস্ব আদায়ে সরকারকে আরও মনোযোগী হয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক চাপের সহনশীলতা তৈরিতে মুদ্রানীতি ও মুদ্রা বিনিময় হারের আধুনিকায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন খুবই জরুরি বলা হয়েছে। সুদহারের করিডর পদ্ধতি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার প্রবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি কার্যকর সুদহার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মুদ্রার বিনিময় মূল্য সহনশীল থাকে।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অর্থের ঘাটতি পূরণে ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতাগুলো নিরসন করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নন-পারফর্মিং লোন বা এনপিএল কমিয়ে আনা ও অভ্যন্তরীণ শেয়ারবাজারের উন্নয়ন করা হলে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সহায়ক হবে বলে তাগিদ দেওয়া হয়।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যবিত্ত রাষ্ট্রের মর্যাদায় উন্নীত হতে হলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিনিয়োগ ও নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের জানান, আইএমএফের দেওয়া শর্তাবলির মধ্যে বেশির ভাগই পুরোপুরি বা আংশিক অর্জিত হয়েছে। যে দুই একটি অর্জিত হয়নি সেগুলোর ব্যাপারে বাস্তবতা উল্লেখপূর্বক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপত্র সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইএমএফ ঋণ কর্মসূচিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬টি অবশ্যকরণীয় বিষয় ছিল। এর মধ্যে ৪টি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। আর দুটির মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে কোনো সফলতা নেই। এ জন্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা বাস্তবতার কথা আমরা আইএমএফ প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরেছি এবং ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়াদি নিয়ে একমত হয়েছি। অপর বিষয়টি রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত। এটির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে থাকলেও আমাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এখানে আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। তবে রেমেডিয়াল বা করণীয়গুলো সম্পর্কে আরও অগ্রগতি সাধনের জন্য আমরা যত্নবান হব বলে তাদের জানিয়েছি।’
মুখপত্র বলেন, যে চারটি শর্তাবলি সম্পর্কে অগ্রগতি নিয়ে আইএমএফ প্রতিনিধিদল পুরোপুরি ‘কনভিন্সড’ সেগুলোর মধ্যে আছে সুদহার বাড়ানো, রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল) অনুসরণ করা, একক মুদ্রা বিনিময় হার প্রবর্তন করা এবং ব্যাংকিং খাতে যে স্ট্রেসগুলো আছে তা ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে তুলে ধরা।
তিনি বলেন, ‘আমরা আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি আমরা। ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছি।’
গত ৪ অক্টোবর আইএমএফ প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। বাংলাদেশের জন্য গত জানুয়ারিতে অনুমোদিত ঋণ কর্মসূচিতে দেওয়া শর্তাবলির বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে দুই সপ্তাহ সময় ধরে আইএমএফ প্রতিনিধিদল অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে বৈঠক করে। এ ছাড়া দফায় দফায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেছে প্রতিনিধিদল। সফর শেষে ১৯ অক্টোবর ঢাকা ত্যাগের আগে আইএমএফ জানায় তাদের প্রতিবেদন ১২ ডিসেম্বর পর্ষদ সভায় উত্থাপন করা হবে।
এমএ/