বাংলাদেশে একসময় বাণিজ্যিকভাবে অঞ্চলভিত্তিক নানা ধরনের ফল উৎপাদন হতো। কিন্তু বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলাতেই বাণিজ্যিকভাবে ফলের আবাদ হচ্ছে। এতে ফল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটছে। মাটিতে সঠিক পরিচর্যা, উন্নত জাত আর আধুনিক চাষাবাদের কারণেই ফল চাষে আশার আলো সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই যুগ আগেও এ দেশে আম আর কাঁঠাল ছিল প্রধান ফল। বাড়ির আনাচে কানাচে ফেলে দেওয়া বীজ থেকে চারা ও গাছ থেকে ফল উৎপাদন হতো। কিন্তু বর্তমানে জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, সফেদা, লটকন ও তরমুজ চাষ হচ্ছে।
এ ছাড়াও বিদেশি ফল, মাল্টা, অ্যাভোকেডো, স্ট্রবেরি, থাই সফেদা, খাটো জাতের নারিকেল, আরবি খেজুর, রাম্বুটান, চেরি, আলুবোখারা, নাশপাতি, ড্রাগন ফ্রুট ও ডুরিয়ানও চাষাবাদের আওতায় এসেছে।
ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ফসল পুষ্টির জন্য মাটি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান গ্রহণ করে বিধায় বিভিন্ন ফসল আবাদের ফলে মাটির উর্বরতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বিভিন্ন ফসল মাটি থেকে বিভিন্ন পরিমাণে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। তাই ঘাটতি পূরণের জন্য জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা উচিত। এ ছাড়াও কিছু অঞ্চলে মাটির উর্বরতা মাঝারি। জৈব পদার্থের পরিমাণও কম, এসব অঞ্চলে সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি কিন্তু ক্যালসিয়াম অনুপাতে কম। তাই এসব অঞ্চলে সার বেশি পরিমাণ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে জৈব পদার্থ প্রয়োগ করা উচিত। আগে কৃষকরা মাটিতে জৈব সার ব্যবহারের দিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু বর্তমানে তারা বিভিন্ন ধরনের সার সঠিক নিয়মে ব্যবহার করে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ফলনও হচ্ছে দ্বিগুণ। বর্তমানে দেশে চাষ হচ্ছে ৭২ প্রজাতির ফল।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘অধিক ফলন পেতে হলে উন্নত জাত, আধুনিক কৃষি পদ্ধতি ও মাটির পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে। অনেক মাটিতে সঠিক গুণাগুণের পরিমাণ কম। ফলে ওইসব মাটিতে শুধুমাত্র জৈব সার ব্যবহার করলেও আশানুরূপ ফলন আসে না। ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী রাসায়নিক সারও ব্যবহার করতে হয়। এতে মাটির গুণাগুণ পরিবর্তন হয় না। তবে অতিরিক্ত সার প্রয়োগের মাধ্যমে মাটির গুণাগুণ কমে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলের উৎপাদন বাড়ার আরেকটি প্রধান কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। গাজীপুর কাঁঠাল-পেয়ারার জন্য ও পিরোজপুর পেয়ারা, ডাব ও আমড়া চাষের জন্য বিখ্যাত। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এসব ফল দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়াও রাজশাহীর আম ও দিনাজপুরের লিচু আবহাওয়া জনিত কারণেই অন্য জেলার চেয়ে স্বাদ ভালো হয়।’
একই বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু জাফর মো. মোসলে উদ্দিন বলেন, ‘উপযুক্ত মাটি না হলে অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে কাঙ্ক্ষিত ফসল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় আবাদি জমির পরিমাণ খুবই কম। তাই এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল আবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। বর্তমানে কৃষকদের পাশাপাশি শিক্ষিত বেকার যুবকরাও বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান করছেন। এতে সঠিকভাবে মাটির পরিচর্যা হচ্ছে। তারা উচ্চফলনশীল, রোগ, পোকামাকড় সহনশীল ও আবহাওয়া উপযোগী উন্নত জাত চাষ করে সফলতা পাচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাড়ন্ত গাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের গোড়া থেকে সামান্য দূরে সার ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। ফলন্ত গাছে সাধারণত বছরে দুবার সার প্রয়োগ করতে হয়। সঠিক সময়ে পরিমিত সার প্রয়োগ করলে মাটির গুণগত মান পরিবর্তন না হয়ে ফলন বাড়বে।’
দীর্ঘদিন ধরে ফল নিয়ে গবেষণা করে আসছেন বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম মিঠু। তিনি দৈনিক খবরের কাগজকে জানান, বর্তমানে প্রতি বছর দেশে ভালো ফলন হচ্ছে। কিন্তু এখানেও চাহিদার তুলনায় কম। এ জন্য প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ফল এদেশে আমদানি করতে হয়। আমদানি বন্ধ করে রপ্তানি করতে জোর দেওয়া হচ্ছে। সে অনুযায়ী ফল নিয়ে গবেষণা চলছে। একে একে উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন নতুন উন্নত জাত।
তিনি আরও জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বীজ থেকে ফলগাছ হওয়ায় ফলন ও গুণমান উভয় নিম্নমানের হয়। এ জন্য মানসম্পন্ন কলম-চারার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের চাহিদা ২০০ গ্রাম। আগে অসুখ না হলে কেউ ফল খাওয়ার কথা ভাবতেন না। কিন্তু এখন প্রতিদিন তাদের খাবারের তালিকায় থাকছে বিভিন্ন ধরনের ফল।
এ বিষয়ে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ‘উৎপাদন বাড়াতে হলে মাটির গুণগত মান বজায় রেখে চাষাবাদ করতে হবে। আমরা চাই আমাদের কৃষিকে আধুনিক কৃষিতে, বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে যেন কৃষকরা চাষাবাদ করে লাভবান হন। আমরা এখন খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিশ্চিতে জোর দিচ্ছি।’