সময়ের আগেই জমি থেকে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছেন রাজবাড়ীর কৃষকরা। পেঁয়াজ পরিপক্ব হওয়ার আগেই বিক্রি করায় উৎপাদন ব্যাহতের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে, বাজারে পেঁয়াজের ভালো দাম থাকায় অধিক লাভের আশায় চাষিরা পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন। এভাবে চলতে থাকলে জেলার পেঁয়াজের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে পেঁয়াজ চাষে তৃতীয় অবস্থানে আছে রাজবাড়ী। দেশের মোট ১৪ শতাংশ পেঁয়াজ রাজবাড়ীতে উৎপাদিত হয়। জেলায় দুই ধরনের পেঁয়াজের আবাদ হয়। একটি মুড়িকাটা পেঁয়াজ অন্যটি হালি পেঁয়াজ। এ বছর জেলায় ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে হালি পেঁয়াজ এবং পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ তোলা শেষ হয়েছে। এখন জমিতে শুধু হালি পেঁয়াজ রয়েছে। হালি পেঁয়াজের চারা ডিসেম্বর থেকে শুরু করে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত রোপণ করা হয়। চারা রোপণের তিন মাস পরে পেঁয়াজ তোলা যায়। সে হিসাবে প্রতি বছর আগাম জাতের হালি পেঁয়াজ মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে বাজারে আসে। এ বছর জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার টন। জেলার পাঁচটি উপজেলায় পেঁয়াজের আবাদ হয়।
সরেজমিনে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর, মাশালিয়া, বহরপর, আড়কান্দি পেঁয়াজের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার মাঠভর্তি শুধুই পেঁয়াজের আবাদ। পেঁয়াজ গাছের রং এখনো সবুজ। গাছ মারা যাওয়ার পর পেঁয়াজ পরিপক্ব হয়। তখন পেঁয়াজের ফলন আসে। আগাম জাতের পেঁয়াজ পরিপক্ব হতে এখনো ১৫ থেকে ২০ দিন বাকি। কিন্তু এসব এলাকার সবাই এখন পেঁয়াজ তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। খেত থেকেই বস্তা ভরে বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক এলাকায় আবার ব্যবসায়ীরাও মাঠ থেকে পেঁয়াজ কিনছেন।
চাষিরা বলছেন, অপরিপক্ব পেঁয়াজের উৎপাদন হচ্ছে অনেক কম। যেখানে প্রতি শতাংশে দেড় থেকে দুই মণ পেঁয়াজ হওয়ার কথা সেখানে ৩০ থেকে ৪০ কেজি হচ্ছে। তবে ফলন কম হলেও বাজারে বাড়তি দাম থাকায় তারা লাভবান হচ্ছেন।
পেঁয়াজ চাষিরা জানান, এখন এক মণ পেঁয়াজ প্রকারভেদে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বিঘায় যদি ৩০ মণ পেঁয়াজ হয়, তবে ১ লাখ টাকা বিক্রি করা যাচ্ছে। কিন্তু সরকার যদি পেঁয়াজ আমদানি করে তখন এক মণ পেঁয়াজের দাম হবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ফলন ভালো হলেও তখন লোকসান গুনতে হবে তাদের।
চাষিদের অভিযোগ প্রতি বছর পেঁয়াজ আমদানির কারণে তাদের লোকসান গুনতে হয়। এজন্য এখন বাড়তি দাম থাকায় পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছেন।
বালিয়াকান্দি উপজেলার মাশালিয়া গ্রামের চাষি রাজিব শেখ বলেন, ‘পেঁয়াজের এত দাম আমি আগে কখনো দেখেনি। কয়েকদিন আগেই পেঁয়াজ বিক্রি করছি ৪ হাজার ২০০ টাকা মণ। এখন একটু দাম কমেছে তারপরও ৩ হাজার ৬০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। এজন্য পেঁয়াজ কম পরিপক্ব হলেও তুলে বিক্রি করে দিচ্ছি। কারণ গত বছরও পেঁয়াজের মৌসুমে দাম ছিল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা।’
অপর চাষি জলিল মল্লিক বলেন, ‘শুনছি সরকার পেঁয়াজ আমদানি করবে। যদি আমদানি করে তখন দাম কমে যাবে। এজন্য পরিপক্ব হওয়ার আগেই তুলে বিক্রি করে দিচ্ছি। যদিও ১৫ দিন পরে এই পেঁয়াজ তুললে শতাংশে কমপক্ষে ২০ কেজি বৃদ্ধি পেত। তারপরও লাভ তো হচ্ছে।’
পেঁয়াজ চাষি আকরাম হোসেন বলেন, ‘এখন পেঁয়াজের মৌসুম। আর ১৫ দিন পর থেকে পেঁয়াজ তোলা শুরু হবে। কিন্তু শুনছি সরকার পেঁয়াজ আমদানি করবে। সবাই পেঁয়াজ তুললে এমনিতেই দাম কমবে। তারপরও যদি আমদানি করে তখন দাম কমে যাবে সেই ভয়েই আমরা পেঁয়াজ তুলছি। আর এই পেঁয়াজ তোলার কারণে দেশের ক্ষতি হচ্ছে এটাও আমরা বুঝতে পারছি। তারপরও লাভের আশায় পেঁয়াজ তুলছি।’
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অনেক কৃষক সময়ের আগেই পেঁয়াজ তুলছেন। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের এই অপরিপক্ব পেঁয়াজ না তোলার জন্য বলা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে দাম থাকায় তারা কোনো কথা শুনছেন না। এভাবে পেঁয়াজ তুলে ফেললে পেঁয়াজের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। এ বছর আবহাওয়া ভালো ছিল। পেঁয়াজের রোগ বালাই কম ছিল। এজন্য সঠিক সময়ে পেঁয়াজ উত্তোলন করলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হতো।’