![কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সনদ পেল সিএসই](uploads/2024/03/21/1711010103.BSEC.jpg)
নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করলো দেশের পুঁজিবাজার। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের নিবন্ধন সনদ পেলো দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। আনুষ্ঠানিকভাবে সিএসইকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের নিবন্ধন সনদ প্রদান করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
দেশে আর্থিক বাজারে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম চালু হচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। দেশের প্রথম কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে দেশের চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি (সিএসই) ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বুধবার (২০ মার্চ) এক অনুষ্ঠানে সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিমের হাতে সনদ তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। বিএসইসির মাল্টি-পারপাস হলে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিমের হাতে সনদ তুলে দেন বিশেষ অতিথি হিসেব উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডা. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ অনেকটা স্টক এক্সচেঞ্জ বা শেয়ার কেনাবেচার বাজারের মতো। স্টক মার্কেটে বহু কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করতে শেয়ার বিক্রি করে এবং তা কিনে নেন বহুসংখ্যক বিনিয়োগকারী। কমোডিটি এক্সচেঞ্জও তেমনই। তবে এখানে শেয়ার নয়, পণ্য কেনাবেচা হয়। এই পণ্য কেনাবেচা সাধারণ পাইকারি বাজারের মতো নয়। বড় পাইকারি দোকানে (পাইকাররা যাকে মোকাম বলেন) ক্রেতা ও বিক্রেতা সরাসরি দর কষাকষি করে পণ্য কেনাবেচা করেন। কিন্তু কমোডিটি এক্সচেঞ্জে ক্রেতা ও বিক্রেতার সরাসরি পণ্য কেনাবেচার সুযোগ নেই। অনেকটা শেয়ারের মতো বিক্রেতার দেওয়া পণ্যের সার্টিফিকেট (সনদ) বিক্রি হয়। মান সনদ দেখেই পণ্যের গুণগতমান বিষয়ে নিশ্চিত হন ক্রেতা এবং অন্য দেশে থেকেও শেয়ার কেনাবেচা করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো বৃহৎ বাজার বিবেচনায় কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সম্ভাবনা অনেক। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের নতুন মাত্রা যোগ হবে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের মূল্য সম্পর্কে সবাই ধারণা পাবেন। তখন আর কেউ পণ্যের মূল্য কম বা বেশি দেখিয়ে (আন্ডার বা ওভার ইনভয়েসিং করে) আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে না। ফলে টাকা পাচার ও রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ হবে। সর্বোপরি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুলবে নতুন দিগন্ত। এটি বিএসইসির অন্যতম একটি বড় অর্জন বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (কমোডিটি এক্সচেঞ্জ) বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী প্রথমবারের মতো সিএসইকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ সনদ বুঝিয়ে দেয়। তবে এ সনদ গ্রহণের সিএসইকে মানতে হবে একাধিক শর্ত। বিএসইসির সহকারী পরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব শর্ত উল্লেখ করা হয়।
সিএসইকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের নিবন্ধন সনদের জন্য পালন করতে হবে কয়েকটি শর্ত। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের নিবন্ধনের জন্য গত ১৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে বিএসইসির কাছে দাখিল করা চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের মেমোরেন্ডাম এবং আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন, সাধারণ বিধিবিধান, এজিবি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তিসহ কোনো বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতি ছাড়া সংশোধন, প্রতিস্থাপন কিংবা বাতিল করা যাবে না। একই সঙ্গে নিবন্ধিত সনদটি বিক্রি, বন্ধক, ইজারা বা অন্যথায় হস্তান্তর বা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জের প্রয়োজন মোতাবেক দৈনিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক এবং বার্ষিক প্রতিবেদন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে সরবরাহের নির্দেশ দিয়ে বিএসইসি জানায়। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে জড়িত সকল পরিচালক, কর্মকর্তা, ট্রেক হোল্ডার বা পণ্য ডেরিভেটিভস ব্রোকারদের কমিশনের সঙ্গে আদেশ, নির্দেশিকা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।
বিএসইসি কর্তৃক আরোপিত শর্তের মধ্যে রয়েছে স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টররা ইস্যু তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে তাদের সব শেয়ার স্টক বা সিকিউরিটি লিংকওয়ের মাধ্যমে স্থানান্তরের আগে কোম্পানির কোনো শেয়ার ধারণ করতে পারবেন না। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একটি হলফনামা দাখিল করার নির্দেশও দেওয়া হয়।
বিএসইসি কর্তৃক কমোডিটি এক্সচেঞ্জের এই সনদ স্থগিত বা বাতিলের ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত তা বৈধ থাকবে। এ ব্যাপারে কমিশন প্রয়োজন অনুযায়ী ভবিষ্যতে আরও শর্তারোপ করার অধিকার রাখে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
শেয়ারবাজারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জেও নির্দিষ্ট ও অনুমোদিত ব্রোকারের মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচা করতে হয়। থাকতে হয় নিজ বা প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাকাউন্ট। একেবারে স্টক মার্কেট থেকে শেয়ার কেনাবেচার মতো ব্যাপার। তবে এই বাজারে পণ্য কিনে তা ডেলিভারি না নিয়ে ক্রয়কৃত সার্টিফিকেট অন্য কারও কাছে বিক্রি করা হয়। অনেকটা মিলগেটে ডেলিভারি অর্ডার বা ডিও কেনাবেচার মতো।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জে মূলত খনিজ ও কৃষিপণ্য কেনাবেচা হবে। শুরুতে তিনটি খনিজ পণ্যকে তালিকাভুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে। তালিকাভুক্ত পণ্য কেনাবেচা হবে ক্যাশ সেটেলমেন্ট ও নন-ডেলিভারি ক্যাশ সেটেলমেন্টের যেকোনো একটি পদ্ধতিতে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (কমোডিটি এক্সচেঞ্জ) বিধিমালা ২০২৩-এ কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিশোধিত মূলধনের নিট সম্পদ হিসেবে সব সময় ৭৫ শতাংশ রাখতে হবে। কোম্পানি আইন ১৯৯৪ মোতাবেক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হতে হবে।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার থাকবে, যারা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে বিনিয়োগ করবে। এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মোট পরিশোধিত মূলধনের সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। সিআইবি রিপোর্ট অনুসারে ব্যাংকের ঋণখেলাপি না হলে পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডাররা কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে। এই এক্সচেঞ্জের কোনো পরিচালক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী জালিয়াতি, বিশ্বাসভঙ্গ বা কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী হতে পারবেন না। এসব শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে কমিশনের কাছে ১০ লাখ টাকার পেমেন্ট অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট বা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করতে হবে।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় ১৩ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে সাতজন থাকবেন স্বতন্ত্র পরিচালক। ওই স্বতন্ত্র পরিচালকদের মধ্যে থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে একজনকে নির্বাচিত করা হবে।
তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথমবারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) কর্তৃপক্ষ। বিএসইসি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বেশকিছু শর্ত সাপেক্ষে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর অনুমোদন দেয়।
এজন্য পরামর্শক হিসেবে ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের (এমসিএক্স) সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে সিএসই। চুক্তির পর এমসিএক্সের সহযোগিতায় নিজস্ব প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিনিধিদের নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণও দিয়েছে সিএইসি।