দেশে বিপুল পরিমাণ গরু, ছাগল উৎপাদন হওয়ায় মাংসে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ উৎপাদন হলেও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি না থাকা এবং আন্তর্জাতিক মানের কোয়ারেন্টাইন সার্টিফিকেট না থাকায় গবাদিপশুর মাংস (রেড মিট) রপ্তানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না না বাংলাদেশ। আর ভালো মানের মাংস থাকার পরেও প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার রপ্তানির বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
নির্দিষ্ট রপ্তানি পণ্য, বিশেষ করে মাংসের জন্য হালাল সার্টিফিকেশন নীতি প্রণয়ন রপ্তানিকারকদের দীর্ঘদিনের দাবির সমাধান করেছে। অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহৃত রপ্তানি-নির্ভর হালাল পণ্যের বিপণনে নিযুক্ত কোম্পানিগুলোকে এখন এনওসি ও সংশ্লিষ্ট লোগো প্রদর্শন করতে হবে। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে এনওসি প্রদানের জন্য মনোনীত কর্তৃপক্ষ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা হালাল পণ্যের প্রচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, বাংলাদেশের বার্ষিক রেড মিট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১০ লাখ ৬০ হাজার টন। এর মধ্যে কোরবানির ঈদে ৪০ শতাংশের বেশি উৎপাদিত হয়। ঈদে ৩০-৪০ শতাংশ মাংস সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট বলে জানান সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। মাংসের বেশির ভাগই আসে গ্রামীণ এলাকায় পালন করা গবাদিপশু থেকে। মাংস উৎপাদনের জন্য উদ্বৃত্ত গবাদিপশু জবাই করা হয় না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে হিমায়িত মাংস হিসেবে বিপুল পরিমাণ মাংস রপ্তানির সুযোগ হাতছাড়া হয়।
বেঙ্গল মিটের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আল-আমিন খবরের কাগজকে বলেন, হিমায়িত গবাদিপশুর মাংস রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) চুক্তি নেই।
তিনি বলেন, দেশে বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা (ওআইই) থেকেও ছাড়পত্রের অভাব রয়েছে। যেটি প্রাণীর রোগ নিয়ন্ত্রণের সমন্বয়কারী, সমর্থন এবং প্রচারকারী আন্তঃসরকারি সংস্থা। যার অনুমোদন মাংস রপ্তানির জন্য বাধ্যতামূলক। বেশির ভাগ মাংস রপ্তানিকারক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পশুখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় এবং গরুর ব্যবসায় সিন্ডিকেট মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপের কারণে মাংস উৎপাদন ব্যয়বহুল।
তিনি বলেন, খামার থেকে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সরাসরি পশু বিক্রি করা হবে এমন একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যেতে পারে। দেশের মাংস রপ্তানির বাজারে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিদিনই আমরা বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে চাহিদা পাই। কিন্তু কোনো জিটুজি চুক্তি ও ওআইই সার্টিফিকেট না থাকায় আমরা পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রতিবেশী দেশগুলো যে দামে মাংস রপ্তানি করে সেই দামে আমরা বিক্রি করতে পারি না। কারণ আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি। ফলে দামের প্রতিযোগিতায় দেশের রপ্তানিকারকরা পিছিয়ে পড়ছে।
ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি কেজি লাল মাংসের রপ্তানি মূল্য প্রায় ৪ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার, যা ৫২০ টাকার সমান। তবে বাংলাদেশে প্রতি কেজি মাংস (গরুর মাংস) বিক্রি হয় ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। বাংলাদেশে এক কেজি মাটনের দাম ১১০০ টাকা, পাকিস্তানে ৪৪৩ টাকা।
ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের গবাদিপশুর খাদ্যের দাম এবং পরিবহন খরচ অনেক বেশি, অথচ ব্যবসায় অনেক মধ্যস্বত্বভোগী আছে যারা অযথা বিভিন্ন স্তরে দাম বাড়ায়।’
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মহাব্যবস্থাপক প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ শরীফ আহমেদ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন লাল মাংস রপ্তানিতে বাংলাদেশ যেসব বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তা দূর করতে সরকারের জরুরি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিদেশ থেকে মহিষের মাংস আমদানি বন্ধেরও পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলেন, পশু লালন-পালন ও পণ্য সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করলে মাংস, হাড়, শিং ও চামড়া বিদেশে রপ্তানি করে বছরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মতো দেশ থেকে মাংস আমদানি করে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মানসম্পন্ন ও হালাল মাংস উৎপাদনকারী হিসেবে বাংলাদেশের মাংসের চাহিদা ব্যাপক।
বেঙ্গল মিট দেশের একমাত্র গরুর মাংস রপ্তানিকারক। প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানিটি দুবাই, কুয়েত, মালদ্বীপ এবং বাহরাইনে রপ্তানি বাজার খুলে দেয়।
গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট ২০২২-২৩ অনুযায়ী, হালাল খাদ্যের বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩০ নাগাদ ৫ ট্রিলিওন ছারিয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলো ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের বাজারে দিন কে দিন বাড়ছে। হালাল খাদ্যের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারের বার্ষিক বৃদ্ধি প্রায় ১০ শতাংশ, যার মূল্য আনুমানিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ব্রিটেন ও আমেরিকায় মুসলিম ও অমুসলিমদের উভয়ের জন্য হালাল মাংসের বাজার ক্রমবর্ধমান। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি খুবই কম।
গবাদিপশু জবাইয়ের স্বাস্থ্যবিধি বিবেচনা করে হালাল মাংসের বাজার দ্রুত বাড়ছে, যা শুধু মুসলিম ভোক্তাদের চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এমন পরিস্থিতিতে হালাল মাংস বাংলাদেশের রপ্তানি ঝুড়িতে নতুন পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোয় পাঠানোর জন্যও প্রয়োজনীয় কাঠামো উন্নয়ন সম্ভব হয়নি বলে জানান ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।