![দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ ব্যাংক](uploads/2024/06/26/bank-news-1719382803.jpg)
বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে কোনো নেতিবাচক খবর হলে সাধারণ মানুষও তা নিয়ে কথা বলে। দোষত্রুটি খোঁজে। ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার খবর এলে সবাই প্রথমেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা অন্বেষণ করেন। এতদিন এসব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু অর্থনীতিতে চলমান সংকটের প্রেক্ষাপটে এখন নিজের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল রাখার কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিটে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের কেউ কেউ প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ‘মক রিসার্চ’ বা পরীক্ষামূলক গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে প্রচারিত একটি সংবাদ নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়দায়িত্বের মধ্যে থাকা জটিল ও বিশেষায়িত ইস্যুগুলোর ভুল ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয় ওই প্রতিবেদনে। এ ছাড়া মূল্যায়ন করার ব্যর্থতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভালো কাজগুলোও নেতিবাচক খবর হিসেবে সম্প্রচারিত বা ছাপা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে একটি সংবাদ চূড়ান্তকরণের আগে সাংবাদিকতার নীতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে ওই তথ্যের ব্যাপারে ব্যাখ্যা বা মন্তব্যও নেওয়া হয় না।
কর্মকর্তারা বলছেন, নগদ টাকার ব্যবহার কমিয়ে এখন দেশে ক্যাশলেস লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকিং সেবা এখন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। ছাত্রছাত্রী, কৃষক, শ্রমিক, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী সবাই ব্যাংকের সেবা পাচ্ছেন। লাখ লাখ মানুষকে সরকারি ভাতা দেওয়া হচ্ছে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে। ব্যাংকগুলোকে দিয়ে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তি ও বৃক্ষরোপণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মতো কাজগুলো করানোর ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, আজকের দিনের প্রয়োজনীয় ই-ব্যাংকিং সেবার সব ব্যবস্থাই করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
করোনা অভিঘাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা
করোনার ভয়াবহ অভিঘাতের সময়ে শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কিস্তি বিলম্বে পরিশোধের সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া মাত্র ৪ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ বিতরণ, ক্রেডিট কার্ড বিলে কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে বিলম্ব মাশুল আদায় না করার সুবিধা গ্রাহক পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। মহামারির সময়ে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ব্যবসা পুনরুদ্ধারসহ টিকে থাকতে সহযোগিতা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের জন্য নগদ সংরক্ষণ সীমা বা সিআরআর ও বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি সংরক্ষণের সীমা কমিয়ে তহবিল সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। অর্থনীতির গতি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দিয়ে শিল্প ও কৃষিতে ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়।
করোনা-পরবর্তী নীতি পদক্ষেপ
করোনার পরের বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয় অস্বাভাবিকভাবে। এর সঙ্গে যোগ হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ওই অস্বাভাবিক প্রবণতা ঠেকিয়ে রিজার্ভের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে আমদানির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের দরের বিপরীতে টাকার মানের সমন্বয় ঘটাতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়। এতেও সমস্যা কেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখতে পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার ডিলারদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানায় ডলারের একটি গ্রহণযোগ্য দর নির্ধারণ করে দিতে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান উচ্চহার ঠেকাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে সুদহারে স্মার্ট করিডর পদ্ধতির সূচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক উদ্যোগ
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হওয়ার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। গতবছরের জুলাইয়ে এ অর্থবছর শুরুর দিকে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২টি বড় সংস্কার আনে। তার একটি ছিল সুদহারের ৯:৬ পদ্ধতির অবসান এবং অন্যটি হলো ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহার ভিত্তি ধরে নতুন স্মার্ট করিডর পদ্ধতির সূচনা। এতে ঋণের সুদহার বাড়ে। উদ্দেশ্য ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শেষদিকে এসেও ওই পদ্ধতির প্রত্যাশিত সুফল না আসায় স্মার্ট করিডর অবসান করে মে মাসে সুদহার বাজারের ওপর বা ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে ঋণের সুদহার আরও বেড়ে বর্তমানে ১৩-১৪ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, এর মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে আসবে।
ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, সরকারের চলতি হিসাবের নেতিবাচক অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে, এখন উদ্বৃত্ত হয়েছে। আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি হয়েছিল। সেটা কমে এখন ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে। আর্থিক হিসাবের বড় চ্যালেঞ্জ চলে গেছে, যা আছে তাও জিরো হয়ে যাবে অচিরেই। আশা করছি, ক্ষয় হয়ে যাওয়া রিজার্ভ আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে রিবিল্ড (পুনর্গঠন) হওয়া শুরু হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. এজাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানুয়ারিতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েছি। এ নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতির জন্য মৌলিক কার্যক্রম ব্যাহত না হয় এমন অর্থ সরবরাহ ঠিক রেখে উড়ন্ত বা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থাকা প্রয়োজনের বেশি অর্থ টেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নেওয়া। এ লক্ষ্যেই নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ করা হয়। এতে ঋণের সুদহার বাড়ার ইঙ্গিত ছিল। ফলে বেসরকারি খাতে অর্থ কম যাবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে এ পরিস্থিতি মানতে হবে।’
ড. এজাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ক্রলিং পেগ দিয়েছি। এখন ডলারের বিনিময় হার বাজারমুখী হচ্ছে। আশা করছি শিগগিরই আমরা একটি সঠিক একক দর পেয়ে যাব। তাহলে রেমিট্যান্স বাড়বে এবং ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে।’