ঢাকা ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন জরুরি

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:১১ এএম
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন জরুরি
প্রাবন্ধিক ও গবেষক হীরেন পণ্ডিত

সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অর্থনীতি, সুশাসন, পরিবেশ ইত্যাদি অনেক কিছুর সঙ্গেই নির্ভর করে। আমরা জাতীয় উন্নয়নের জন্য এসডিজির অভীষ্ট লক্ষ অর্জনে কাজ করছি। স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বজনীন করে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলাই সবার লক্ষ্য। 

স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতিও পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যের উন্নতিতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ পুরস্কৃত হয়েছে। তারপরও সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি এখনো বহু দূরে। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে যে জাতীয় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, অবকাঠামো, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন সে জন্য আরও কাজ করতে হবে।

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চাহিদা নগরাঞ্চলের স্বাস্থ্য চাহিদা থেকে গ্রামাঞ্চলে ভিন্ন। আঞ্চলিক ভিন্নতার কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এলেও নীতি প্রণয়নে কিংবা পরিকল্পনায় এর সুবিবেচনা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের দেশে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। 

সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ব্যয় জনগণের আয় ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে পরিবেশ দূষণ, বিষাক্ত খাদ্যগ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে আশঙ্কাজনকহারে বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটছে। বিশেষ করে বাড়ছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক এবং কিডনি সমস্যাসহ অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি। চিকিৎসা হয়ে উঠছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। 

দেশের চার শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়ে যায় স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত খরচের জন্য। কোনো দেশে কোনো নাগরিকের স্বাস্থ্য ব্যয় তার সামগ্রিক ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি হলে সেই দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল বলে বিবেচিত হয়। আমরা চাইলে খুব সহজেই একটি স্বাস্থ্য বিমাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। 

স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের যেকোনো আলোচনাতেই প্রাধান্য পায় কোথাও ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, হাসপাতাল নেই, সিট নেই, হাসপাতালের দুরবস্থা, দুর্নীতি, অনিয়ম, বাজেটে বরাদ্দ কম, দালালদের উপদ্রব ইত্যাদি অনেক বিষয়। এর প্রতিটি বিষয়ই চিকিৎসাকেন্দ্রিক। এ বিষয়গুলোরও আলোচনা ও সমাধান প্রয়োজন। 

স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে মানুষের অধিকার, কারও দয়া বা করুণার বিষয় নয়, এটাও সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে বোঝানো। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছেন তাদেরও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে এসডিজির গোলসমূহ অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও এর গুণগতমান নিয়ে জনমনে অসন্তোষ রয়েছে, রয়েছে হতাশা। চিকিৎসাসেবা এখন আর সেবা নয়, ব্যবসায় পরিণত হয়েছে বলেই অভিযোগ রয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এত আয়োজনের পর চিকিৎসাসেবার গুণগতমান কেমন এবং এই সেবা নিয়মিত ও সবাই সন্তুষ্টিসহকারে পাচ্ছে কি না, সেটিই আসল বিষয়। 

স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ভালো কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন। এমন ভালো ব্যক্তিদের নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যায়। প্রতিটি কাজের জবাবদিহির পথ খোলা রাখুন। কাজের গুণগত মনিটরিং ও প্রত্যেকের নিরপেক্ষ মূল্যায়নের ব্যবস্থা নিন এবং সেবাগ্রহণকারীরাই হোক প্রকৃত মূল্যায়নকারী।  

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫ হাজার ৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে কিছু অর্জন আছে, যা চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে রয়েছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমানো। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বরাবরই ইস্যুভিত্তিক ছিল। সার্বিক কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের পর দেখা গেছে, অনেক ব্যবসায়ী, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা কিংবা রাজনীতিবিদ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। স্বাভাবিক সময়ে অনেকে বাংলাদেশে চিকিৎসা করানোর বিষয়টি চিন্তাও করতেন না। কিন্তু দুর্যোগের এই সময়ে সরকারি হাসপাতাল হয়ে উঠেছিল একমাত্র ভরসা। ডেঙ্গু চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই দেখা যাচ্ছে।

সারা দেশে ১৭ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও সরকারি বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং জাতীয় টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশ ইতোমধ্যেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কিছু এলাকায় পাইলট আকারে হেলথ স্কিমের মাধ্যমেও ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ কার্যক্রম সরাসরি চলছে। পর্যায়ক্রমে তা সারা দেশে চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে। যদিও দেশে এখনো সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রমে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এখনো দলিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বিশেষ করে দিনমজুর, হিজড়া সম্প্রদায়, নরসুন্দর, যৌনকর্মী, জেলে, মুচি, মেথর, আদিবাসী সম্প্রদায়সহ অনেককে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবা নিতে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের মন-মানসিকতার কারণে। এসব জনগোষ্ঠী তাদের প্রবেশাধিকারের বিড়ম্বনার কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

মানুষকে যখন পকেটের পয়সা খরচ করে স্বাস্থ্যসেবা নিতে হবে না, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে যখন প্রয়োজন তখনই যেকোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা বিনামূল্যে গ্রহণ করতে পারবেন তখনই আমাদের দেশে ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হবে। এ জন্য আরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। 

এখন আমরা আছি এসডিজি যুগে। আগে আমাদের প্রত্যাশা ছিল সবার জন্য স্বাস্থ্য। এখন বলা হচ্ছে, সবার জন্য সহজলভ্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্য। সবার জন্য স্বাস্থ্য বলতে যে প্রত্যাশার কথা আমরা বলি তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে দিনবদলের কারণে প্রত্যাশাকেও এখন আমাদের নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর মতো নতুন নতুন রোগ মহামারির আকার নিচ্ছে। এখন মহামারি হচ্ছে ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিস। এগুলো হচ্ছে নতুন যুগের, মানে এসডিজি যুগের মহামারি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের কোনো মানুষ যেন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিকিৎসা করাতে গিয়ে যেন আরও দরিদ্র বা নিঃস্ব না হয়, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশে সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্যবিমা কার্যকর করা জরুরি। স্বাস্থ্যবিমা করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ মেটানো।

স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক ঝুঁকি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, একজন বিমাকারী বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণ করতে পারেন। যেমন মাসিক প্রিমিয়াম অথবা পে-রোল ট্যাক্স, যা বিমার চুক্তি অনুযায়ী তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ জোগাবে। যার ভেতর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব খরচ, প্রতিবন্ধিত্ব অথবা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যাদি।

সরকারি হিসাবের তথ্য বলছে, আমাদের স্বাস্থ্যের পেছনে যত খরচ হয়, তার ৬৭ শতাংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে খরচ করছে। অথচ বৈশ্বিক মান হচ্ছে ৩৪ শতাংশের মতো। তার প্রায় দ্বিগুণ আমরা খরচ করছি। আমাদের কাছে স্বাস্থ্য খরচ একটা বড় বোঝা। স্বাস্থ্যসেবার খরচের বিষয়টি আমরা ঠিকমতো স্বীকার করি না। স্বাস্থ্য খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে শুধু দরিদ্র নয়, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও নিঃস্ব হয়ে যায়। কারণ, এখন অসুখের ধরনও পাল্টে গেছে। ক্যান্সার অথবা ক্রনিক অসুখের কারণে অনেককে ওষুধ খেয়ে যেতে হয় নিয়মিত। কিছু উদ্যোগ অবশ্য সরকারের আছে। অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিলি করার বড় ধরনের প্রোগ্রাম আছে। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। প্রান্তিক, দলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকারে বিড়ম্বনার বিষয়টি সামনে এসেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা মূলত বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যা অধিকাংশ আমেরিকানের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির মূল উৎস। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) একটি সরকারিভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, যেখানে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সবাই স্বাভাবিকভাবেই এ স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ইতোমধ্যে বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিমা চালু করেছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা। প্রকল্পটি দরিদ্র মানুষদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা আর আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধার মেলবন্ধনের কারণে। অন্য স্বাস্থ্যবিমায় যার নামে বিমা করা থাকে, তাকে প্রিমিয়াম দেওয়ার কথা, কিন্তু সরকার এই বিমায় সেই প্রিমিয়াম দিয়ে দেয়। গরিব মানুষ বিনামূল্যে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা অবধি অনেক চিকিৎসা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই পেতে পারেন। ৩০ টাকার বিনিময়ে হতদরিদ্র মানুষ পেতে পারেন তাদের পরিবারের সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা। একটি স্মার্ট কার্ড নিয়ে গেলেই হাসপাতালে এক পরিবারের পাঁচজন সদস্য এক বছরে পান ৩০ হাজার টাকার চিকিৎসাসেবা। ২০০৮ সালের ১ এপ্রিল দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষদের জন্য চালু হওয়া ওই বিমায় ছয় বছরের মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ পরিবার যুক্ত হয়েছে।  

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে বছরে ৬৪ লাখ মানুষ গরিব থেকে আরও গরিব হচ্ছে। এদের মধ্যে ১৫ শতাংশ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ নিজের পকেট থেকেই ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দিন দিন আরও গরিব হয়ে পড়ছে। দ্রুত স্বাস্থ্য খাত বিমার আওতায় আনতে না পারলে ব্যক্তিগত ব্যয় আরও বাড়তেই থাকবে।

স্বাস্থ্য অর্থ ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১ শতাংশেরও কম মানুষ স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এসেছে। অর্থাৎ ৯৯ শতাংশের অধিক মানুষ এখনো স্বাস্থ্যবিমার বাইরে রয়েছে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, করপোরেট হাউস ও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু রাখলেও এসব বিমায় সব ধরনের স্বাস্থ্যসুরক্ষা দিতে পারছে না। আমাদের দেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, কেউ চাইলেই এত সহজে সব মানুষকে কিন্তু বিমার আওতায় আনা সম্ভব হবে না, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও কঠিন। এ অবস্থায় আমাদের প্রথমে উচ্চবিত্ত থেকে ক্রমান্বয়ে মধ্যবিত্তদের আগে বিমার আওতায় আনতে হবে। আয়ের অনুপাতে এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী বিমার প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা যেতে পারে। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেও বিমার আওতায় আনতে হবে, তবে তা হতে হবে খুবই স্বল্পমূল্যে বা সম্ভব হলে বিনামূল্যে। অর্থাৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিমার আওতায় থাকবে, কিন্তু তার প্রিমিয়াম সরকারিভাবে দেওয়া যেতে পারে। এখানে আরও একটা বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, যেন গতানুগতিক বিমার মতো সেবা পেতে দেরি না হয়। যেভাবে জাতীয় পেনশন স্কিম করা হয়েছে সেরকম একটা কিছু নিয়েও এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
[email protected]

সর্বজনীন পেনশন আগে পরে সবাই এর আওতায় আসবেন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
আগে পরে সবাই এর আওতায় আসবেন
মাহবুব আহমেদ

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সবাই এর আওতায় আসবেন। কেউ আগে আবার কেউবা পরে। সবারই এ কর্মসূচির আওতায় আসা উচিত। এতে ক্ষতি নেই। আমিতো ক্ষতির কিছুই দেখি না। বরং জীবনের শেষদিকে একটি আর্থিক নিরাপত্তা হিসেবে এমন একটি কর্মসূচি দরকার ছিল।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এ সিস্টেম আছে। সেটা চিন্তা করেই আমাদের এখানে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটা পর্যায়ে সবাইকেই এ কর্মসূচির আওতায় আসতে হবে। এ বছর শিক্ষকরা আসছেন। আগামী বছর থেকে সরকারি কর্মচারীরা এর আওতায় আসবেন।

বেসরকারি পর্যায়ে তো নির্দিষ্ট প্যাকেজই রয়েছে। সব উন্নত রাষ্ট্রেই বার্ধক্যে এ ধরনের নিরাপত্তামূলক আর্থিক কর্মসূচি দিয়ে সেফগার্ড দেওয়া হয়।

সাবেক অর্থসচিব

সর্বজনীন পেনশন আলোচনায় বসলেই সব ঠিক হয়ে যেত

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১১ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
আলোচনায় বসলেই সব ঠিক হয়ে যেত
নজরুল ইসলাম খান

পেনশন স্কিমে কয়েকটি বিষয় নতুন আছে। এগুলো আলাপ-আলোচনা করে নিলেই ঠিক হয়ে যেত বলে মনে করি।

দূরত্ব না বাড়িয়ে বরং কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। দূরত্ব না বাড়ানো ভালো। বিশেষ করে যারা ব্যবস্থাপনায় আছেন তাদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেভাবে হঠাৎ করেই অচল করে ফেলা হলো সেটাও কতটা ঠিক হয়েছে, তা দেখা দরকার। এর পেছনে অন্যকিছু আছে কি না, তা নিয়ে আমি কিছুটা শঙ্কিত।

তবু এখনো আলোচনায় বসে প্রয়োজনে কিছু বিষয় সংশোধন করার সুযোগ আছে। কত টাকারই বা ব্যাপার। হয়তো আমাদের অর্থনৈতিক কিছুটা সমস্যার কারণে সহজেই প্রয়োজনীয় অনেক কিছু করা যায় না।

সাবেক শিক্ষা সচিব

ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত প্রয়োজন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৫ পিএম
ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত প্রয়োজন
আবুল কাসেম ফজলুল হক

শিক্ষকদের দাবির বিষয়টি বিবেচনা করে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে এর সমাধান হয়ে যায়। যারা সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পেনশন পান তাদের বিষয়ে আপাতত কোনো হস্তক্ষেপ বা পরিবর্তন না করা ভালো। এটা চলছে, সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সরকার কেন পরিবর্তন করতে চাচ্ছে তা ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না।

তবে যারা এখনো সরকারি চাকরি করেন না তাদের জন্য আলাদা পেনশন ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে। সেটি করলে সরকার ভালো কাজ করত।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনায় শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে কোনো কিছু পাস করানো এই জিনিসটা ভালো না। সরকারকে বা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা যায়।

জনসভা, মিছিল প্রতিবাদ করতে গেলে সংগ্রামের ব্যাপার দাঁড়ায়। সব কিছুতেই সংগ্রাম করতে হবে এরকম না। বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা, সংগ্রামের অনেক ক্ষেত্র আছে। তাই বিষয়টি ভালো করে বুঝে অল্প সময়ে সমাধান করা উচিত।

সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৬ পিএম
আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত
এ কে আজাদ চৌধুরী

এটা আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশনের কথা বলেছেন, সবাইকে রাখতে পারতেন। সেটাই ভালো হতো।

শিক্ষকদেরকে সবার সঙ্গে মেশানো হলো আর ব্যুরোক্রেটদের (আমলাদের) আলাদা করে রাখা হলো। এতে একটা অনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই হিসেবে তো আমি এটা সমর্থন করতে পারি না।

সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করায় বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তবে এটা তো সংশোধন করা যায়।

আমার মনে হয়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।

সাবেক চেয়ারম্যান, ইউজিসি
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:০১ এএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:০১ এএম
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছরে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ পর্যন্ত যেসব অর্জন হয়েছে সেগুলোকে সুসংহত করে যেতে আমাদের বর্তমান কতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন, কৌশল নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন।

সরকারের ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে এবং চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনটি মূল সমস্যা নিয়ে আমি এতদিন যথেষ্ট আলোকপাত করেছি, সেগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, অপর্যাপ্ত রিজার্ভ এবং জ্বালানি সমস্যা। এগুলোর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক সমস্যা আছে। যেমন- ব্যাংকিং খাতের সমস্যা, পুঁজিবাজারের সমস্যা, অর্থপাচার এবং দুর্নীতি। 

বাজেটে সমস্যাগুলোর সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। পরোক্ষভাবে কিছু কিছু আংশিক নীতি ও কৌশলের উল্লেখ আছে কিন্তু সেগুলো সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। আমার মতে, বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। সামনে জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪-এর মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।  সেটাতেও আমি মনে করি, সমস্যাগুলোর সমাধানে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

রাজস্বনীতিতে যেখানে বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং মুদ্রানীতি, দুটার পেছনেই সঠিক দর্শনের অভাব এবং নীতির সীমাবদ্ধতা আমরা বহুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি। সেই সঙ্গে কৌশলগুলোর দুর্বলতা এবং সবশেষে বাস্তবায়নের ব্যর্থতা দিন দিন বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে প্রকট করে তুলছে। এই নিবন্ধে আমি নীতি, কৌশল এবং বাস্তবায়নের প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করছি।

আর্থিক খাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এখন আসা যাক বাজেটের পলিসিগত দুর্বলতা প্রসঙ্গে। বাজেটে বিরাট ঘাটতি আছে। ঘাটতি পূরণে সরকারকে কর নিতে হবে বেশি। ঘাটতির জন্য সরকারকে ঋণ নিতে হবে। ঋণ অভ্যন্তরীণ সেক্টর থেকে নেবে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বেশি নেবে। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে আসবে। কর বাড়াবে, বিশেষ করে পরোক্ষ কর বাড়াবে। প্রত্যক্ষ কর হয়তো কিছু বাড়াবে। করের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। করের যে আদায় এবং কর যে কার কাছ থেকে নেবে- এগুলো সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা দেখতে পেলাম না। 

সাধারণত সব দেশে পরোক্ষ কর সবচেয়ে কম ওঠায়। কারণ পরোক্ষ করে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু যারা ধনী, যারা অবস্থাপন্ন, সম্পদশালী, তারা প্রত্যক্ষ কর দেয়। যাদের কর দেওয়ার সামর্থ্য আছে, অর্থ আছে, আয় আছে, তারা দেবে। কিন্তু এটার কোনো কিছুই এখানে ফলো করা হয় না। অতএব, ট্যাক্স বাড়বে, নতুন করে লোকদের ওপর করের বোঝা বাড়বে। এতে কি ট্যাক্স জিডিপি বাড়বে? আমার তো মনে হয় না। কারণ এনবিআরের যে সক্ষমতা, উদ্যোগ ও মনোযোগ থাকবে যারা ট্যাক্স দিচ্ছে, তাদের দিকে।

এখন আসা যাক মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতির ব্যাপারে। আমার মনে হয়, মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় নেই। কারণ মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। বাজেট সম্প্রসারণশীল। কিছুটা খরচ বাড়বে, যদিও খুব বেশি বাড়ে না। বিরাট একটা বাজেটঘাটতি আছে। সেই খরচটা কমাতে পারত যদি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আরও কাটছাঁট করে ছোট করে নিয়ে আসা যেত। বাজেটে যে করের হিসাব দিয়েছে, বিভিন্ন প্রণোদনা, সরকারের ঋণ গ্রহণ, সেগুলো মুদ্রানীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক।

এখন মুদ্রানীতিতে কী কী করা উচিত? ভবিষ্যতে কী করতে হবে? ভবিষ্যতে যেটা করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথমত প্রাথমিকভাবে খুব দ্রুত একটা পর্যালোচনা করতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে। আগের মুদ্রানীতির ইমপ্যাক্টটা কী? এটার জন্য খুব একটা যে সময় লাগবে তা নয়। মুদ্রানীতিটা কী কী কাজে লেগেছে, তাদের উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। শুধু মুদ্রানীতিতে আবার কিছুটা টার্গেট দেবে, কিছু রিজার্ভ মানি টার্গেট, ক্রেডিট টার্গেট, পলিসি রেট- সেগুলো দিতে পারবে। 

কিন্তু এর আগে পর্যালোচনা করতে হবে, আগের টার্গেটগুলোর কী হয়েছে? এগুলোর ফল কী হয়েছে? আগের কৌশলগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে। কারণ গত মুদ্রানীতিতে আমরা তেমন সফলতা দেখিনি। এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কথা বলছি, বাজেটের সময়ে যে বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে, বিভিন্ন বিষয় অ্যাড্রেস করতে হবে। এগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথমত যেটা হলো, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছি। যেটা আমরা বলছি, চাহিদাটাকে কমানো। চাহিদা যদি কমানো হয়, মূল্যস্ফীতি কমবে। পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করেছে, পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করলে বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে অর্থের সরবরাহ কমবে। সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। আমাদের সঞ্চয় বা ব্যাংকের জামানতকৃত টাকা কমে যাচ্ছে। ওই দিকে চাহিদা বাড়ছে। ফলে সুদের হার বাড়ছে। সুদের হারটা আগে নয়ছয় ছিল, সেটা মোটেও যুক্তিসংগত ছিল না। সেটা বাড়িয়েছে।

এখন ক্রলিং পেগ করেছে। ক্রলিং পেগ হলো একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ওঠানামা করবে। কিছুটা বেড়েছে হয়তো, রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে ইদানীং। ক্রলিং পেগে ক্রল করে তো বেশি কিছু হয়নি। বিভিন্ন দেশে ক্রলিং পেগের অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। ওপরে নামবে, নিচে নামবে। আমাদের মূল সমস্যা- ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে কেন ওঠানামা করছে? রিজার্ভ কেন কমে যাচ্ছে? বাইরে থেকে ফরেন কারেন্সি কেন আসছে না?

জ্বালানির ব্যাপারটা সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। কিন্তু জ্বালানির উপাদান তো আনতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, ডিজেল, পেট্রল আনতে হবে। সেগুলোর জন্য ফরেন রিজার্ভ কতটুকু দরকার, সেটা তো অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচ্য বিষয় হবে।

এর জন্য মুদ্রানীতিতে যেটা দরকার, সেটা করতে হবে। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বাজেটে তো কিছুই তেমন বলেনি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো খেলাপি ঋণের ব্যাপারে একটার পর একটা ছাড় দিয়েই যাচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে এক জায়গায় বলেছিলাম, ‘খেলাপি ঋণ একটা ব্যবসায়িক মডেল হয়ে গেছে।’ এই মডেল একটা ভালো মডেলের বিকৃত রূপ। মডেল হবে ঋণ নেবে, ঋণ ফেরত দেবে। লোকজনের কর্মসংস্থান করবে। 

ঋণটা সুস্থভাবে আদায় করবে। ঋণটা শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হবে না, পুঁজিবাজারের ওপরে হবে। এগুলো কিছু নেই, কিছুই হয়নি। যারা ঋণখেলাপি, তারা ব্যাংক থেকে শুধু ঋণ নিয়ে নিচ্ছে, শোধ দিচ্ছে না। কিন্তু দিন দিন ওদের ব্যবসার প্রসার হয়তো ঘটছে। ব্যবসার প্রসার না ঘটুক, দিন দিন বিপুল পরিমাণে ওদের আয় ও সম্পদ বাড়ছে। এটা বাংলাদেশে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেউ বলে সারপ্রাইজ, কেউ বলে মিরাকল। 

আবার কেউ বলে বাংলাদেশ একটা আদর্শ। ব্যাংকিং মহলে এই আদর্শ বা মিরাকলের ব্যাপারটা অনেক ক্ষুণ্ন করেছে খেলাপি ঋণ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতটাকে আমূল সংস্কার করতে হবে। খেলাপি ঋণ কী কারণে হচ্ছে? ব্যাংকের সুশাসন কেন হচ্ছে না? বাংলাদেশে কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতি শুধু টার্গেট দিয়ে হবে না। কী কী করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, কী কী ব্যাংক করবে- সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

মুদ্রানীতি ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট সম্পর্কে সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মত নীতি ও কৌশল দেবে, এটাই কাম্য। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ, ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট মানে সেখানে দেশে বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে, সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। অতএব ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইমপ্রুভ করতে হলে বাইরে থেকে অর্থ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে।

আমি মনে করি, মুদ্রানীতি এবার ফরেন রিজার্ভ এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করতে হবে। কী কী পদক্ষেপ থাকবে এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ডেভেলপ করার কৌশল থাকবে। ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটটাকে আলাদা করে দেখতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেটটাকে শুধু রেমিট্যান্স আনার ব্যাপারে নয়, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ সহায়ক করতে হবে। মার্কেট মনিটর করতে হবে।

গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। টাকাটা কনভার্ট করে ব্ল্যাক মার্কেট থেকে অথবা কার্ব মার্কেট থেকে ডলার কিনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা নানা রকমভাবে অর্থ পাচার করে, হুন্ডি করে, তাদের ধরতে হবে। কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিষয়টা শুধু মুদ্রানীতির ব্যাপার নয়, আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দূর করতে সরকারকে এ ব্যাপারে অতিসত্বর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়নের দুটি মূল গুরুত্বপূর্ণ অর্জন- নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু সামনের দিকে যেতে হলে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের আপামর জনসাধারণের মানোন্নয়ন এবং একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অর্থনীতির সব খাতের নীতির সমন্বয়, কার্যকরী কৌশলের প্রণয়ন, সর্বোপরি বাস্তবায়নের দিকে অতিসত্তর দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াস নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়