![অবৈধ পথে অভিবাসী হতে গিয়ে নিখোঁজ ৩, জিম্মি ৭](uploads/2024/01/16/1705421581.Untitled2.jpg)
মানব পাচার সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে অনেক পরিবারে বিপর্যয় নেমে এসেছে। অবৈধ উপায়ে ইতালিতে অভিবাসী হতে গিয়ে গত ডিসেম্বর মাসে নিখোঁজ হয়েছেন লিবিয়াপ্রবাসী টিটল সরদার (২৩)। ইউরোপের দেশ ইতালি গিয়ে ভালো আয় রোজগার করে পরিবারে সচ্ছলতা আনার স্বপ্ন ছিল। আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লিবিয়ায় শ্রমিক হিসেবে আয় কম। তাই অল্প খরচে ইতালিতে ঢুকার ব্যাপারে দালাল তাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন।
টিটলের বাড়ি মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানাধীন পশ্চিম আলীপুর গ্রামে। পিতার নাম মন্নান সরদার। তিনি দুই বছর ধরে লিবিয়াপ্রবাসী। তার সঙ্গে একই নৌকায় যেতে চুক্তি করেছিলেন আরও ৯ জন। সবাই মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার বাসিন্দা এবং লিবিয়াপ্রবাসী। মোট ১০ জনের মধ্যে বর্তমানে নিখোঁজ রয়েছেন ৩ জন। বাকি ৭ জন প্রাণে বাঁচলেও বর্তমানে তিউনিসিয়ায় পাচার চক্রের হাতে জিম্মি রয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী অভিবাসী হতে ইচ্ছুক ১০ জনের প্রত্যেকের পরিবার দালাল চক্রের প্রধান লিবিয়া প্রবাসী সোহেল সেপাইয়ের কথামতো দেশে থাকা তার লোকজনকে প্রথম দফায় প্রত্যেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা করে মোট ৬৫ লাখ টাকা প্রদান করেন।
পরে দফায় দফায় ওই ১০ জনের পরিবারের কাছ থেকে আরও টাকা নেওয়া হয়। মোট দেওয়া টাকার পরিমাণ ১ কোটি ২৫ লাখ। হাতে হাতে নগদ টাকা, ব্যাংক হিসাব ও বিকাশ অ্যাকাউন্টে এসব টাকা দেওয়া হয়। টাকা প্রদানের সব রেকর্ডও সংরক্ষণ করেছে ওই ১০ জনের পরিবার। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে এ টাকা দেওয়া শুরু হয়। চলে নভেম্বর পর্যন্ত। তারপরই আসল চিত্র বেরিয়ে আসে। সোহেল সেপাই সটকে পড়েন। অভিবাসী হতে ইচ্ছুক ভিকটিমদের কেউই ইতালি যেতে পারেননি।
উপরন্তু, নিখোঁজ তিনজনের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিচ্ছে না সোহেল সেপাই। তিউনিসিয়ায় জিম্মি থাকা বাকি ৭ জনকে ইতালি পাঠানো ও থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ জনপ্রতি আরও ৪ লাখ টাকা করে দাবি করছেন সোহেলের অন্যতম সহযোগী তিউনিসিয়ায় থাকা হুমায়ুন। এই হুমায়ুনের বাড়ি বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। অবিলম্বে দাবিকৃত টাকা দেওয়া না হলে বাকি সাতজনও নিখোঁজ হয়ে যাবেন বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় সোহেল সেপাই ভিকটিম ১০ জনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।
ইতোমধ্যে কে বা কারা ভিকটিমদের পরিবারকে জানিয়েছেন যে, নিখোঁজ তিনজনের কিডনি ও অন্যান্য মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তুলে নিয়ে লাশ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে নিখোঁজ হওয়া ৩ জনের পরিবারে এক অজানা শঙ্কা নেমে এসেছে। প্রিয় সন্তান বেঁচে আছে না মারা গেছে তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন প্রত্যেকের মা-বাবা। উপায়ান্তর না দেখে ভিকটিমদের পরিবারের পক্ষ থেকে আত্মীয় পরিচয়ে জসিম সরদার নামে এক ব্যক্তি গত পহেলা জানুয়ারি আইনি সহায়তার জন্য কালকিনি থানায় গেলে পুলিশ সোহেল ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি। তবে, ‘পরে দেখবেন’ বলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন অভিযোগের লিখিত আবেদন ও সংযুক্ত যাবতীয় তথ্য প্রমাণের কাগজপত্র রেখে দেন।
কে এই সোহেল সেপাই
দালালচক্রের অন্যতম প্রধান দীর্ঘদিন লিবিয়াপ্রবাসী সোহেল সেপাই (৩৫)। তার বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানার মালতকান্দি (গোপালপুর) গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আলী আজগর সেপাইয়ের বড় ছেলে। সোহেল দীর্ঘদিন লিবিয়ায় থেকে মানব পাচার সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছেন। তিনি লিবিয়া থেকে ইউরোপের দেশ ইতালিতে লোক পাঠানোর কন্ট্রাক্ট নেন। একপর্যায়ে দেশে থাকা সোহেলের পিতা আলী আজগর সেপাই ও লিবিয়ায় থাকা তার পুত্র সোহেল টিটলের পরিবারের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনলাইন কলে যুক্ত হয়ে চুক্তি চূড়ান্ত করেন।
চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়া থেকে টিটলকে ইতালি নিতে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে সোহেলকে। প্রথম কিস্তিতে নগদ ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় সোহেলের পিতা আলী আজগর সেপাইকে। এরপরই সোহেলের মূল ফাঁদ স্পষ্ট হতে শুরু করে। টিটল ও তার পরিবারকে সোহেল জানায়, একজন মাত্র নিয়ে ইতালি যাওয়া যাবে না। আরও কয়েকজনকে জোগাড় করতে হবে। টিটলের পিতা মন্নান সরদার এ সময় বিষয়টি তার ভাই জসিম সরদারকে জানান। টিটল তার সঙ্গে থাকা লিবিয়াপ্রবাসী আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে আরও ৯ জনকে জোগাড় করেন। এবার মোট ১০ জনের পরিবারের কাছ থেকে পালাক্রমে টাকা নেন সোহেলের চক্রে জড়িত থাকা সদস্যরা।
চুক্তি চূড়ান্ত করার আগে সোহেলের পিতা আলী আজগর সেপাই ও দেশে থাকা তার অপর ছেলে জুয়েল সেপাই (২৭) টিটলের পিতা মন্নান সরদার ও তার ভাই জসিম সরদারদের বাড়ি যান। ইতালি নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয় সোহেলের স্ত্রী স্বপ্না বেগম (৩০) কে।
থানায় লিখিত অভিযোগ
সব ভিকটিমের পক্ষে কালকিনি থানায় জসিম সরদার বাদী হয়ে দেওয়া লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, মোট আসামি করা হয়েছে সোহেল সেপাই, তার ভাই জুয়েল সেপাই, ওই দুজনের পিতা আলী আজগর সেপাই, সোহেলের স্ত্রী স্বপ্না বেগম, টাকা লেনদেনে যুক্ত থাকা মাদারীপুরের কালকিনি থানার পূর্ব আলীপুর গ্রামের হাকিম হাওলাদারের পুত্র সাইফুল হাওলাদার এবং তার সহযোগী জনৈক আল আমিনসহ মোট ছয়জনকে।
জসিম সরদার লিখিত অভিযোগ দিতে কালকিনি থানায় যান পহেলা জানুয়ারি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন ওই দিন মামলা হিসেবে অভিযোগ নিতে অনীহা প্রকাশ করে জানান, এ ধরনের মামলা নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে, নির্বাচন (জানুয়ারির ৭ তারিখ) হয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি দেখা হবে।
ভিকটিমদের পরিচয়
লিখিত অভিযোগকারী জসিম সরদার খবরের কাগজকে জানান, ভিকটিমদের তিনজন তার আপন ভাগনে ইব্রাহিম সরদার, পিতা-ফোরকান সরদার, সাং-পশ্চিম আলীপুর, রিয়াদ হোসেন, পিতা-জালাল সরদার, সাং-চর বিভাগদী ও শরিফুল ইসলাম, পিতা-মো. মতি মুন্সী, সাং-লক্ষ্মীপুর।
তার চাচাতো ভাই শিপন সরদার, পিতা-ধলু সরদার, সাং-পশ্চিম আলীপুর, শ্যালক আনোয়ার সরদার, পিতা-শুকুর সরদার, সাং-চর আলীপুর, সম্বন্ধীর ছেলে আঃ মালেক বেপারি, পিতা-আনোয়ার বেপারি, সাং-চর আলীপুর, ফুফাতো ভাই দিদার মোল্লা, পিতা-রুপাই মোল্লা, সাং-স্বস্থাল, ভাতিজা আতিকুর সরদার, পিতা-আঃ জলিল সরদার, সাং-বাঁশগাড়ী, মামাতো শ্যালক ইয়ামিন সরদার, পিতা-ইকবাল সরদার, সাং-কালিগঞ্জ এবং ভাতিজা টিটল সরদার, পিতা-আঃ মন্নান সরদার, সাং-পশ্চিম আলীপুর। সবাই মাদারিপুর জেলার কালকিনি থানার বাসিন্দা এবং ১০ জনই লিবিয়াপ্রবাসী।
নিখোঁজ ৩ জনের পরিচয়
ওই ১০ জনের মধ্যে জসীম সরদারের দুই ভাতিজা শরিফুল ইসলাম, পিতা-মো. মতি মুন্সী, সাং-লক্ষ্মীপুর ও টিটল সরদার, পিতা-আঃ মন্নান সরদার, সাং-পশ্চিম আলীপুর এবং মামাতো শ্যালক ইয়ামিন সরদার, পিতা-ইকবাল সরদার, সাং-কালিগঞ্জ বর্তমানে নিখোঁজ রয়েছেন।
টাকা লেনদেন
সোহেলের পিতা আলী আজগর, স্ত্রী স্বপ্না ও বিভিন্ন সময়ে সোহেলের পাঠানো লোকজনকে নগদ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের ফাসিয়াতলা বাজার (কালকিনি) এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা এবং প্রায় ১৬টি বিকাশ নাম্বারে টাকা প্রদান করা হয়। এসব লেনদেনের ডকুমেন্টস থানায় দাখিল করা লিখিত অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
সোহেল সেপাইর বর্তমান অবস্থান
সোহেল সেপাই ভিকটিমদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করার পর টাকা লেনদেন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা সোহেলের এক সহযোগীর মাধ্যমে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সোহেল গতকাল মঙ্গলবার ভোরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। তার পাসপোর্ট নাম্বার ই কে ০০৬৬৬৩৫।
মামলা গ্রহণ ও পুলিশের তৎপরতা
অনুসন্ধানের প্রয়োজনে কথা বলতে যোগাযোগ করার পর ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ক্রাইম) সাজ্জাদুর রহমান গত সোমবার কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অভিযোগটি নিয়ে তৎপর হতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে আন্তদেশীয় মানব পাচার চক্রের সঙ্গে সোহেলের সম্পৃক্ততা আছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে বলেন।
সাজ্জাদুর রহমান খবরের কাগজ প্রতিবেদককে সোমবার তার দপ্তরে আরও জানান, গত এক মাসে বিদেশে কর্মসংস্থানের নামে পাচারকৃতদের মধ্য থেকে শুধু বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের প্রায় ৪ শতাধিক লোক ফেরত এসেছেন। এদের সবার মামলা থানায় নেওয়া হয়নি। আদালতের মাধ্যমে আদেশ নিয়ে থানায় মামলা এসেছে এসবের ৯০ ভাগ।
তিনি বলেন, লোভে পড়ে গোপনে চুক্তি ও লেনদেন করে অনেক টাকা পয়সার বিনিময়ে অভিবাসী হতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। যখন বুঝতে পারেন প্রতারিত হয়েছেন, তখন পুলিশের কাছে আসছেন আইনি সহায়তা নিতে। এ সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের কিছু করার থাকে না। যদি সফলভাবে প্রত্যাশিত দেশে তারা যেতে পারতেন, তাহলে আর পুলিশের কাছে আসতেন না। যে টাকা খরচ করে তারা বিদেশে যেতে চেয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, সেই টাকায় দেশেই ভালো আয় রোজগার করা সম্ভব।