![দ্রব্যমূল্যে বিব্রত আওয়ামী লীগ, তৃণমূলে ক্ষোভ](uploads/2024/03/06/1709744192.Awami-league.jpg)
এবার ক্ষমতায় এসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে প্রথম চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন এখনো দেখা যায়নি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিব্রত আর ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিসহ সামাজিক পদক্ষেপ বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও বিব্রত ছিলেন দলের নেতারা। নির্বাচনি প্রচারে নেমে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সাধারণ জনগণের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে দলীয় প্রার্থীদের। নির্বাচনি ইশতেহারে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন দলীয় হাইকমান্ড। নতুন মন্ত্রিসভার বয়স প্রায় দুই মাস হতে চললেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। নির্বাচনের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যে বিষয়টিকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি দলের অভ্যন্তরে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। যেসব মন্ত্রী বেশি কথা বলেন তারা সে অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারছেন না। কাজ করতে পারলে তো এই অবস্থা হয় না। যারা এসব বলেছেন তাদের জিজ্ঞেস করুন।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, ‘যারা এসব কথা বলেছেন তাদের জিজ্ঞেস করেন। নিয়ন্ত্রণ কেন হচ্ছে না, এ বিষয়ে তারা উত্তর দিতে পারবেন। আমি এ বিষয়ে বলতে পারব না।’
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিষয়টি নিয়ে সরকার থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে নির্বাচনের পর। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিষয়টিকে সরকারের প্রথম এবং বড় চ্যালেঞ্জ বলে একাধিকবার বক্তব্য দিয়েছেন। ২৮ জানুয়ারি সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দ্রব্যের দাম বাড়ছে, এটা বাস্তবতা, অস্বীকার করে লাভ নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা একটি চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এটা নিয়ে আমরা কাজে বসেছি।’ এক দিন পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে শুধু হুমকি-ধমকি নয়, যে ‘অ্যাকশন’ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হবে।
তবে এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। উল্টো গত বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি ইউনিটে পাইকারিতে ৩৪ পয়সা ও গ্রাহক পর্যায়ে ৭০ পয়সা বেড়েছে। নতুন দর সদ্যসমাপ্ত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কার্যকর করা হয়েছে। প্রান্তিক গ্রাহক থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি, শিল্প সব খাতেই বেড়েছে দাম। এ নিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। গত রবিবার বাড়ানো হয়েছে এলপি গ্যাসের দাম।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে সিন্ডিকেট করে ‘মজুতকারীদের’ গণধোলাই দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যারা সরকার উৎখাতে আন্দোলন করে তাদেরও এখানে কারসাজি আছে। এর আগে দেখলাম পেঁয়াজের খুব অভাব। পরে দেখা গেল বস্তা বস্তা পেঁয়াজ পানিতে ফেলে দিচ্ছে। এ লোকগুলোকে কী করা উচিত, সেটা আপনারাই বলেন। এদের তো গণধোলাই দেওয়া উচিত। কারণ আমরা সরকার কিছু করলে বলবে, সরকার করেছে। পাবলিক যদি প্রতিকার করে, তাহলে সবচেয়ে ভালো, কেউ কিছু বলবে না।
এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠক শেষে সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছিলেন, ‘আমরা একযোগে বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে চাচ্ছি। আগামী ১ মার্চ থেকে এ পরিবর্তন দেখবে দেশ। ভোক্তা থেকে উৎপাদক পর্যায়ে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পলিসি বা ভোক্তা অধিদপ্তর দিয়ে কোনো হ্যারাসমেন্ট (হয়রানি) নয়, বরং সাপ্লাই (সরবরাহ) যথেষ্ট রাখা হবে। পাশাপাশি চালের বস্তায় উৎপাদনের তারিখ, উৎপাদন মূল্য, পাইকারি মূল্য ও খুচরা মূল্য লেখা লেবেল থাকবে।’
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা সময় বেঁধে দিয়ে সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে না পারায় দলের নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের কাছে বিব্রত হচ্ছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি দেশের প্রতিটি মহলে সমালোচিত হচ্ছে অনেক আগে থেকে। তাই সময় দিয়ে নয়, প্রয়োজনে প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কেউ কেউ হতাশার সঙ্গে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তো সরকার অনেক আগে থেকেই কাজ করছে। কিন্তু মানুষও জানতে চায় কবে মূল্য কমবে। বিষয়টি নিয়ে জনগণ অনেক কষ্টের মধ্যে আছে, তাদের কাছে আমরা যারা দল করি তাদের বিব্রত হতে হচ্ছে। তাই বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা যেন আরও সতর্ক হন।’
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। আসলে এ ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও কেন তা হচ্ছে না- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বাজার সিন্ডিকেটের কারণে মানুষ যে কষ্টে আছে, এটা সত্য। ব্যবসায়ীরা যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ান, তা অনৈতিক। শুধু মনিটরিং নয়, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।