নদী-নালা, খাল-বিল থেকে ফসলি জমি; পাহাড়, বনজঙ্গল থেকে সড়ক সবখানে বেনজীর আহমেদের থাবা। অবৈধ দখল, জোর করে স্বল্প মূল্যে কেনা, সংখ্যালঘু উচ্ছেদ করে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়াসহ নানাবিধ ভয়ংকর অপরাধের খবর পাওয়া যাচ্ছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে চারটি ফ্ল্যাট ও অন্তত ৬২১ বিঘা সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে।
বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে আরও অঢেল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে বান্দরবান, সাতক্ষীরা ও গাজীপুরে তাদের নামে থাকা সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও বনভূমি ও জঙ্গল দখল করে বানানো হয়েছে বিনোদন পার্ক, রিসোর্টসহ নানা রকম প্রমোদ বাংলো। নদী-নালা, খাল-বিল বাদ যায়নি কিছুই। ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া বেনজীর আহমেদ গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
খবরের কাগজের অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে বান্দরবানের সুয়ালক এবং লামার ডলুছড়ি এলাকায় প্রায় আড়াই শ বিঘারও বেশি সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে কয়েকটি অসহায় পরিবারের সম্পত্তি ক্ষমতার জোরে নামমাত্র দামে কেনা হয়েছে বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও মেয়েদের নামে। এসব জমি হস্তান্তরে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা। দখলকৃত জায়গাগুলো ফিরে পেতে সম্প্রতি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে অসহায় পরিবারগুলো। শুধু বান্দরবানই নয়, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও কক্সবাজার থেকেও খবরের কাগজের প্রতিনিধিরা অনুসন্ধান চালিয়ে পাঠিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত।
বান্দরবান ও লামায় হাতিয়ে নেওয়া ৮০ একর জমি
বান্দরবানের সুয়ালক মৌজা এবং লামার ডলুছড়ি মৌজায় বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে রয়েছে অন্তত ৮০ একর (২৪০ বিঘা) জমি। এর মধ্যে সুয়ালক এলাকার ২৫ একরজুড়ে থাকা মাছ ও গরুর খামার, ফলের বাগান ও একটি বাংলোসমেত জমিটি স্থানীয় লোকজনের কাছে এসপির জায়গা হিসেবে পরিচিত।
এ জমিতে একসময় অসহায় কিছু পরিবারের বসবাস থাকলেও ক্ষমতার জোরে নামমাত্র মূল্যে এসব জমি অসহায় পরিবারকে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। এসব জমি বেনজীর আহমেদকে পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেন স্থানীয় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৬ সালে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মির্জা ও মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে সুয়ালক মৌজায় ২৫ একর (৭৫ বিঘা) জায়গা লিজ নেওয়া হয় বান্দরবান পৌর এলাকার মধ্যমপাড়ার আবুল কাশেমের ছেলে শাহজাহানের কাছ থেকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বান্দরবান মাঝের পাড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে এই প্রজেক্ট। এখানে রয়েছে একটি গরুর খামার, কয়েকটি মাছের খামার, এসি সুবিধাসহ দোতলা বাংলো। রয়েছে বিভিন্ন ফলদ ও সেগুন বাগান। ভেতরে যেন কেউ প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য কাঁটাতারের বেড়ার পাশাপাশি রয়েছে তালা লাগানো একটি গেট। আশপাশে কোনো বসতি না থাকার পরও সেখানে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। হয়েছে ইটের রাস্তা, যা বাগানে গিয়েই শেষ হয়েছে।
গরুর খামারের দায়িত্বে থাকা দুই ব্যক্তি খবরের কাগজকে জানান, এটি বেনজীর আহমেদের জায়গা হলেও দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন বান্দরবান পৌর এলাকার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মি দো মং মারমার ছেলে ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং। গরুর খামারে বাচ্চাসহ মোট ৩৭টি গরু থাকলেও এবারের কোরবানিতে বিক্রয়যোগ্য গরু রয়েছে ৩৫টি।
এদিকে ডলুছড়ি মৌজার টংগঝিরি পাড়ার সাবেক মেম্বার ফাইসা প্রু বলেন, ‘আমার এলাকায় বেনজীর আহমেদের ৫৫ একর (১৬৫ বিঘা) জমি রয়েছে। এসব জমিতে একসময় অসহায় পরিবারের বসবাস থাকলেও বান্দরবান স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং অল্প টাকা দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দেন। কেউ জানতে চাইলে এ জায়গার ব্যাপারে কাউকে মুখ না খোলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’
বেনজীরকে জমি পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং বলেন, ‘সুয়ালকের মাঝের পাড়ায় বেনজীর আহমেদের জায়গার পাশে আমার কিছু জায়গা আছে। সেই সুবাদে একদিন এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে আমাকে বেনজীর আহমেদের জায়গাগুলো দেখাশোনা করতে বলেন।’
লামার ডলুছড়ির টংগঝিরির জায়গা জখলের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ডলুছড়ি মৌজার জায়গার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ‘বান্দরবানে বেনজীর আহমেদের লিজের জায়গা আছে কিংবা জোর করে জায়গা জবরদখল করা হয়েছে, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমি বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা নেব।’
মাদারীপুরে বেনজীরের জমি ৯০ একর
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় প্রায় ৯০ একর জমি রয়েছে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মির্জার নামে। এসব জমির বেশির ভাগই সংখ্যালঘু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। আইজিপি থাকার সময় ওই জমি সস্তায় বিক্রি করতে তাদের বাধ্য করেছিলেন বেনজীর আহমেদ।
বেনজীরের জমিজমা ক্রোকে আদালতের আদেশ হওয়ার পর এই জমির আগের মালিকরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, রাজৈরের কদমবাড়ী ইউনিয়নের সাতপাড় ডুমুরিয়া, নটাখোলা ও বড়খোলা মৌজায় জমি কেনা হয়েছে বেনজীরের স্ত্রীর নামে। বেনজীর ২০২২ সালে অবসরে যাওয়ার এক মাস আগ পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে কেনা হয় এসব জমি। ১১৩টি দলিলে কেনা এসব জমির বেশির ভাগই ফসলি। কদমবাড়ী ইউনিয়নের ডুমুরিয়া মৌজায় ৬২ শতাংশে এক বিঘা। প্রতি বিঘা জমির দাম সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া শিবচর উপজেলায়ও কিছু জমির সন্ধান পাওয়া গেছে।
১১৩টি দলিলে ৯০ একর জমি বেনজীরের পরিবারের কেনার তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া শিবচর পৌরসভার ঠেঙ্গামারা মৌজায় ২০১৫ সালে পাঁচ কাঠা জমি কেনে বেনজীরের পরিবার। শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ও চরজানাজাত ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় বেনজীর আহমেদের জমি থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গতকাল রবিবার ভুক্তভোগী ভাষারাম সেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের ২৪ একর ৮৩ শতাংশ ফসলি জমির সবটুকুই কিনে নেন সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ। প্রতি বিঘায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। অথচ ওই জমির দাম অনেক বেশি। ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের কাছে থেকে লিখিয়ে নিয়েছেন।’
সাতপাড় ডুমুরিয়া গ্রামের সরস্বতী রায় বলেন, ‘আমাদের জমিতে ফসল হতো, এই ফসলের ওপর আমাদের জীবন চলত। পুলিশের ওই লোক লিখে নেওয়ায় আমাদের চাষাবাদ করার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা জমি বিক্রি করতে চাইনি। ভয় দেখানো হয়েছিল।’
গাজীপুরে ‘বেনজীরের রিসোর্ট’
সদর উপজেলার মেম্বারবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে ইজ্জতপুর সড়ক ধরে চার কিলোমিটার ভেতরে ‘ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’। সেখানকার নলজানী গ্রামে তিন দিকে বনভূমিবেষ্টিত এই রিসোর্ট এলাকার মানুষের কাছে ‘বেনজীরের রিসোর্ট’ নামেও পরিচিত।
অভিযোগ আছে, কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই এ রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিক হয়েছেন পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ। ৫০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা ভাওয়াল রিসোর্টের ৩ দশমিক ৬৮ একর জমি বন বিভাগের। নিরীহ কৃষকদের অন্তত ৪০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই গাজীপুরের রিসোর্টটির মালিক বনে গেছেন বেনজীর।
শুরুতে ১৯ একর জমি নিয়ে রিসোর্টটির কাজ শুরু হলেও বেনজীরের ক্ষমতার জোরে প্রায় ৫০ একর জায়গা দখল করা হয়। এ নিয়ে গতকাল গাজীপুর যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলাও করা হয়েছে। তবে মামলায় বেনজীরকে বিবাদী করা হয়নি।
এর আগেও ভাওয়াল স্টেটের এই সরকারি জমি থেকে রিসোর্টটি উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিল বন বিভাগ। রিসোর্ট মালিকরা মামলা করলে আদালত উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বন বিভাগের পক্ষে রায় হয়েছে। আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছেন। গত বৃহস্পতিবার রায়ের কপি প্রকাশ হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।