ফেঁসে যাচ্ছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীরের অপকর্মের সহযোগীরা। বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতিতে সহায়তাকারীদের তালিকা করছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে বেনজীর আহমেদের অধীন ও ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, বেনজীর ও তার পরিবারের ব্যবসায়িক পার্টনার এবং ঘনিষ্ঠজন ও নিকটাত্মীয়দের তালিকা করা হয়েছে। তাদের নামে থাকা অর্থ-সম্পদেরও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
এ ছাড়া বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পদ ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িদের শনাক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে সম্পত্তির বিক্রেতা, দলিলের মুসাবিদাকারী এবং সাক্ষীদের পৃথক তালিকা করা হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির অনুসন্ধান পর্যায়ে দুই ধরনের ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। এর মধ্যে যারা বেনজীরের দুর্নীতি ও অপকর্মে সরাসরি সহায়তা করে নিজেরা লাভবান হয়েছেন, তাদের অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। আবার আরেক ধরনের আছেন, যারা বেনজীর আহমেদ ও পরিবারের সম্পদ ক্রয় প্রক্রিয়ায় পেশাগত ও অন্যান্য কারণে জড়িত। এ ধরনের ব্যক্তিদের সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।
এ ব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, অনুসন্ধান কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। তারা আইনের মধ্যে যা ভালো মনে হয় করবেন। বেনজীরকে সহায়তা ও মদদ দেওয়ার পেছনে যাদের নাম আসবে, তাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা করেছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন এমন ২০ জন পুলিশ কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া গাজীপুরে ভাওয়াল স্টেটে ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারে তার ব্যবসায়িক পার্টনার, বান্দরবান ও গোপালগঞ্জ বিভিন্ন স্থানে থাকা রিসোর্ট, মৎস্য ও গরুর খামারসহ অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পার্টনার, নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনসহ শতাধিক ব্যক্তির তালিকা করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পর্যায়ক্রমে তাদের দুদকে ডাকা হবে।
এ ছাড়া গুলশানে র্যানকন আইকন টাওয়ারে চারটি ফ্ল্যাট কিনতে বেনজীর আহমেদ কোন প্রক্রিয়ায় মূল্য পরিশোধ করেছেন, প্রকৃত পক্ষে কত টাকা পরিশোধ করেছেন এবং ব্যাংকের মাধ্যমে নাকি নগদে পরিশোধ করেছেন, তা জানতে বিক্রেতাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য ঘটনা বের করতে ওই সব দলিলের মুসাবিদাকারী ও সাক্ষীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
একইভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৬২১ বিঘা জমি কেনার ২০২টি দলিলের বিক্রেতা, মুসাবিদাকারী ও সাক্ষীদের বক্তব্য সংগ্রহ করা হবে।
প্রথমত, তাদের সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে যদি কেউ তথ্য গোপন করেন অথবা অসত্য তথ্য দেন, তাহলে দুদক আইনে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকে বেনজীরের হাজির হওয়া নিয়ে সংশয়
ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে বেনজীর আহমেদ সপরিবারে বিদেশ গেছেন। ফলে আগামী ৬ জুন ধার্য দিনে তার দুদকে হাজির হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে সময় চাইতে পারেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে দুদক কর্মকর্তারা খবরের কাগজকে বলেন, ‘তার (বেনজীর) বিদেশ যাওয়ার দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি না হলে আগামী সপ্তাহে সম্পদের হিসাব চেয়ে তাকে নোটিশ করা হবে। তাকে পাওয়া না গেলে তার বাসার ঠিকানায় এই নোটিশ পাঠানো হবে। তিনি দুদকে না এলে তার অনুপস্থিতিতেই অনুসন্ধানকাজ সম্পন্ন করা হবে।
নির্ধারিত সময়ে অনুসন্ধান শেষ না-ও হতে পারে
দুদক কর্মকর্তারা জানান, আইন অনুযায়ী ৪৫ কর্ম দিবসে অনুসন্ধান শেষ করার কথা। অনিবার্য কারণে এই সময়ে অনুসন্ধান শেষ না হলে আরও ১৫ দিন মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে।
তবে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা কঠিন হবে। কারণ তার অর্থ-সম্পদের পরিমাণ বেশি হওয়ায় সব তথ্য সংগ্রহ করা ও সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন হতে পারে।
এদিকে বেনজীর আহমেদের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেছেন, ‘বেনজীর আহমেদ এখন কোথায় আছেন জানি না। তার বিরুদ্ধে যেহেতু দুদক অনুসন্ধান করছে, নিশ্চয়ই তিনি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবেন। যেহেতু তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি তাই, তার পক্ষে আইনি লড়াই চালানোর কোনো নির্দেশা নেই।’
সোমবার (৩ জুন) সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এসব কথা বলেন।
সহযোগী পুলিশ কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে
একসময়ের প্রতাপশালী সাবেক আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের একটি শক্তিশালী বলয় ছিল। পুলিশ, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই ছিল তার নিজস্ববলয়। এদের প্রভাবে সবাই তটস্থ থাকতেন। বেনজীর আহমেদ চাকরি ছাড়ার পরও সেই প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। শুধু পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে নয়, মাঠপর্যায়েও এই প্রভাব রয়েছে। এখনো বেনজীর আহমেদের প্রায় ১৩ জন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন।
তবে বেনজীরের অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তারা নড়েচড়ে বসেছেন। অনেকেই ঘাপটি মেরে গেছেন।
আবার কিছু কর্মকর্তা তার পক্ষে সরব হয়েছেন। সরব হওয়ার এই সংখ্যা একবারেই কম। তবে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ঘটনার পর পুলিশ আরও সতর্ক রয়েছে। এর মধ্যে বেনজীর আহমেদের সুবিধাভোগীরা যাতে আবার সক্রিয় হতে না পারেন, সেই দিকে নজর রেখেছে পুলিশ।
পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে জড়িত কি-না বা কোনো সম্পদ ক্রয়ের জন্য সরকারি অনুমতি নিয়েছেন কি না, তা খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যারা বদলি তদবিরের সঙ্গে জড়িত তাদেরও নাম আসছে বিশেষ তালিকায়। সরকারি বিধি আদেশ লঙ্ঘন করে কেউ যদি কোনো কর্মকাণ্ড করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজি এ কে এম শহীদুল হক সোমবার বিকেলে খবরের কাগজকে জানান, ‘পুলিশে বদলি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। যদি কেউ টাকা দিয়ে বা কোনো সুবিধা দিয়ে বদলি হয় তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু পুলিশে নয়, সরকারি যেকোনো কর্মচারী বিধি লঙ্ঘন করলেই তিনি শাস্তিযোগ্য হবেন।’
সূত্র জানায়, বেনজীর আহমেদ যেমন তার প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে সম্পদ গড়েছেন তেমন করে তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা না করলে এই সম্পদ অর্জন করতে পারতেন না। এই সব কর্মকর্তাদের মধ্যে পুলিশের বিসিএস ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন। খুলনা এবং চট্টগ্রাম রেঞ্জে কয়েকজন এসপি রয়েছেন। যারা বেনজীরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বেনজীরের একাধিক রিসোর্টে এসব কর্মকর্তার একাধিক শেয়ার আছে বলে জানা গেছে।