বিশ্বকাপ শুরুর আগের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ বিশ্বকাপের পর ক্যাচ ধরার দক্ষতায় ইংল্যান্ডের পর ৮১.০৬ শতাংশ পয়েন্ট নিয়ে তালিকায় দুইয়ে অবস্থান করছে পাকিস্তান। ফিল্ডিংয়ে পাকিস্তানের সেই চিরাচরিত দুর্বলতা তারা কাটিয়ে উঠেছে এমনটাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেই পাকিস্তানই কি না ফের দিল সেই ভুলের খেসারত। বেঙ্গালুরুতে ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ হাত ফসকে যায় বিশ্বকাপ অভিষিক্ত উসামা মিরের হাত থেকে। তাতেই যে পাকিস্তানের হাত থেকে ম্যাচও ফসকে গিয়েছিল। ১০ রানে জীবন পাওয়া ওয়ার্নার নতুন করে নামের পাশে যোগ করেন ১৫৩ রান। আর অজিদের বোর্ডে জমা হয় ৩৬৭ রানের বিশাল সংগ্রহ। বাবর আজমদের সে ম্যাচ হারতে হয় ৬২ রানে।
ক্যাচটা ধরতে পারলে গল্পটা হতে পারত ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ার পুঁজিতে লাগাম টানা যেত শুরুতেই। ওয়ার্নারের ক্যাচ ফেলা উসামা বল হাতেও ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরুচে। ৯ ওভারে ৮২ রান দিয়ে নেন ১ উইকেট। ব্যাট হাতে খুলতে পারেননি রানের খাতা। ম্যাচ শেষে সমালোচকদের সমালোচনায় বিদ্ধ উসামা টুইটারে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ‘সরি’ বলেছেন। ক্যাচ ছুটেছিল অধিনায়ক বাবরের হাত থেকেও। এই উসামার বলে স্লিপেই স্মিথের।
পাকিস্তানের সেদিনের ফিল্ডিং নিয়ে শোয়েব আখতার হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছ না। অন্তত যখন ব্যাটার নিজেই দিচ্ছে ক্যাচ, তখন তো লুফে নাও।’ বিশ্বকাপ বা বিশ্বকাপের বাইরে পাকিস্তানের ফিল্ডিংয়ের হাস্যকর সব ভুল লাখ লাখ ভিউ কামিয়েছে ইউটিউবে।
এবারের বিশ্বকাপে পাকিস্তান অন্যতম সেরা ফিল্ডিং সাইড হওয়ার কথা থাকলেও শেষ তিন বিশ্বকাপে ভুলেভরা ফিল্ডিংয়ের গল্পটার পুনরাবৃত্তিই হলো বেঙ্গালুরুতে।
২০১১ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে মোহালিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে শততম সেঞ্চুরির অপেক্ষায় থাকা শচীনের চারটি ক্যাচ ড্রপ করে পাকিস্তানের ফিল্ডাররা। তিনবারই ক্যাচ ফেলা হয়েছিল আফ্রিদির বলে। শর্ট মিড উইকেটে ২৭ রানে শচীন প্রথম ক্যাচ মিসবাহর হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। অভিজ্ঞ ইউনিস খান ৪৫ ও উইকেটের পেছনে থাকা কামরান আকমল ৭০ রানে ছাড়েন শচীনের পরের দুটি ক্যাচ। ৩৪ ওভারের শেষ বলে উমর আকমল ক্যাচ ছাড়েন। শেষমেশ আফ্রিদিই আজমলের বলে ক্যাচ নিয়ে ফেরান শচীনকে। যদিও ততক্ষণে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ৮৫ রান করেন টেন্ডুলকার। ক্যাচ মিসে শেষ হয়ে যায় পাকিস্তানের ফাইনালের স্বপ্ন। ২৯ রানে হারে তারা। ম্যাচসেরা হন চার চারবার জীবন পাওয়া সেই টেন্ডুলকারই।
১০ বছর পর ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলতে থাকা পাকিস্তানের ঘরেই শিরোপা যাচ্ছে, তা সবাই ধরেই নিয়েছিলেন। কিন্তু বিধিবাম! আবারও সেই ফিল্ডিং ব্যর্থতায় নিজেদের পায়েই কুড়াল মারে পাকিস্তান। দুবাইয়ের সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারলেই ফাইনালে যেত পাকিস্তান। শতরানের আগে অজিদের পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে জয়ের সম্ভাবনার পাল্লা নিজেদের দিকেই নিয়ে এসেছিল। ১৮ ওভারের তৃতীয় বলে মিড উইকেটে ১৩ বলে ২১ রান করা ম্যাথু ওয়েডের ক্যাচ ছাড়েন হাসান আলি। সে বলে আসে দুই রান। এরপর তিন বলে তিন ছয়ে পাকিস্তানকে টুর্নামেন্ট-ছাড়া করেন ম্যাথু ওয়েইড। ১৪ বলে ২৩ থেকে ১৪ বলে অপরাজিত ৪১ রান করে ম্যাচসেরা হন খোদ ওয়েড।
বিশ্ব আসরে পাকিস্তানের ক্যাচ ছাড়ার গল্পটা বোধ হয় অজিদের বিপক্ষেই বেশি। ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপেও ঘটেছে ক্যাচ মিসের ঘটনা। ২০১৫ আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে অ্যাডিলেডে ওয়াহাব রিয়াজ ও শেন ওয়াটসনের সেই মুহূর্ত নিশ্চিতভাবেই কেউ ভোলেননি। ভোলারও নয়। ২১৩ রানের স্বল্প পুঁজির পরও ৫৯ রানে অজিদের ৩ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচ জমিয়ে তোলেন ওয়াহাব রিয়াজ ও সোহেল খান। এরপরই শুরু হয় ওয়াটসনের মাথা বরাবর রিয়াজের মুহুর্মুহু বাউন্সার ছোড়া। ওয়াটসনকে দিশেহারা করে তোলেন বাউন্সার, স্লেজিং ও শরীরী ভাষায়। উড়ন্ত চুম্বনও ছুড়ে দেন তার দিকে। শেষমেশ এই রিয়াজ-ওয়াটসনের ব্যাটেলে ওয়াটসনেরই জয় হয় পাকিস্তানি ফিল্ডার রাহাত আলির ব্যর্থতায়। একের পর এক বাউন্সারে নাস্তানাবুদ হয়ে শেষমেশ ব্যাট চালিয়ে দেন ওয়াটসন। ফাইন লেগে থাকা রাহাত আলি সেই ক্যাচ ছেড়ে দিলে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ধারাভাষ্যে প্রশ্ন করা হয়, বিশ্বকাপটাই কি ফসকে গেল? চাপের মুহূর্তে ওয়াটসন ৬৬ বলে করেন অপরাজিত ৬৪ রান। আর তাতেই সেমিফাইনাল স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় পাকিস্তানের।
টনটনে অ্যারন ফিঞ্চ আর ওয়ার্নারকে যেন জামাই আদর করতে মাঠে নেমেছিল পাকিস্তান। ২০১৯ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে পাকিস্তান হারে ৪১ রানে। এদিনও ওয়াহাব রিয়াজের বলে হয় ক্যাচ মিস। স্লিপে থাকা হারিস সোহেল ধরতে পারেননি ২৬ রানে থাকা অজি অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চের ক্যাচ। আউট হওয়ার আগে ফিঞ্চ করেন ৮২ রান। সেঞ্চুরি করার পর ১০৪ রানে থার্ড ম্যানে আসিফ আলি ছাড়েন ওয়ার্নারের ক্যাচ। সেই ক্যাচে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি, এরপর আর মাত্র ৩ রান যোগ করে ওয়ার্নার শাহিন শাহ আফ্রিদীর বলে ইমাম-উল-হকের হাতে ধরা পড়ে বিদায় নেন। ম্যাচ হারার পেছনে ফিঞ্চের ক্যাচ মিসের দায় এড়ানো যায় না। ক্যাচ মিসের পর ফিঞ্চ নতুন করে যোগ করেন ৫৬ রান। ফিঞ্চের ব্যাটিং আত্মবিশ্বাস জোগায় ওয়ার্নারকেও। তুলে নেন শতক। স্কোর বোর্ডেও জমা হয় ৩০৭ রান।
সেই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে যেতে পারেনি পাকিস্তান। এবারের বিশ্বকাপে ভালো ফিল্ডিং পরিসংখ্যান নিয়ে ভারতে এসেও সেই অজিদের বিপক্ষেই ম্যাচ খুইয়েছে পাকিস্তান ফিল্ডিং ব্যর্থতায়। এখন দেখার বিষয় সেই ব্যর্থতা ভুলে নকআউটে পা রাখতে পারে কি না পাকিস্তান।