![প্রয়োজন নেই, তবুও খাল খননের উদ্যোগ!](uploads/2024/01/10/1704864485.1.-Sherpur-River-1111.jpg)
শেরপুরের নকলায় পাঁচ কিলোমিটার জমিতে খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে এলজিইডি। সরকারি এই অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেড়শ বছরের পুরোনো এই জায়গায় এক সময় খাল ছিল। পরবর্তী সময়ে তা ভরাট হয়ে যায়। নাগরিকের কথা চিন্তা করে এখানে খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যদিও স্থানীয়রা বলছেন, এখানে খাল খননের কোনো প্রয়োজন নেই। যদি খনন করা হয়, তা হলে তাদের উপার্জনের একমাত্র সম্বল তিন ফসলি জমি হারাতে হবে। ‘সুযোগসন্ধানী’ কিছু মানুষ নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে কৃষকের ক্ষতি করতে চাইছে বলেও স্থানীয়দের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। সরকারি এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য তারা একাধিকবার মানববন্ধনও করেছেন।
জানা গেছে, নকলা উপজেলার চন্দ্রকোণা ইউনিয়নের মৃগী নদীর মোহনা থেকে মেহেদীডাঙ্গা পর্যন্ত জমিগুলো এক সময় জলাশয় ছিল। ১৯৮০-৮২ সালের জরিপে ওই জমিগুলো মালিকানাধীন হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। এর পর থেকেই কৃষকরা ধান, ভুট্টা, সরিষাসহ রবিশস্য আবাদ করে জীবন নির্বাহ করে আসছেন। সম্প্রতি মৃগী নদীর মোহনা থেকে মেহেদীডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জমিতে খাল খননের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২ কোটি টাকা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার জানকীপুর, হুজুরীকান্দা ও বন্দটেকী এলাকার বাসিন্দারা বিস্তীর্ণ মাঠে ধান, গম, ভুট্টা, আলু, বেগুন, মরিচ, সরিষাসহ দেশি সবজি আবাদ করছেন। তারা এসব ফসল বিক্রি করে সংসারের খরচ চালান। পাশাপাশি এসব জমির ফসল তাদের সারা বছর খাবারের জোগান দেয়। এ ছাড়া তাদের গৃহপালিত পশুর চারণভূমি হিসেবেও এসব জমি ব্যবহার করা হয়। ফসলের আগাছাগুলো গোখাদ্যের চাহিদা মেটায়। বিস্তীর্ণ মাঠের একটি অংশে জমে থাকা পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। ফলে বাড়তি কোনো খরচ হয় না। স্থানীয়রা জানান, এই খাল খনন হলে তিন ফসলি জমির আবাদ হারানোর পাশাপাশি বাড়িঘর ভাঙনের শঙ্কাও রয়েছে।
জানকীপুর এলাকার বাসিন্দা কৃষক মো. হারেজ বলেন, ‘আমগর (আমাদের) বাপ-দাদার (পূর্বপুরুষ) আমল থেকেই এখানে ধানচাষ করে সংসার চলাইতাছি (খরচ বহন)। আমগর অন্য কোনো কাজের জমি নাই। সারা বছর ধানসহ আমরা বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করি এবং তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাই। এহন (এখন) খাল খুদলে (খনন) আমাদের পেটে লাথি মারা হবে। তাই এই খাল আপনারা বাদ দেন, আমগর খাল দরকার নাই।’
হুজুরীকান্দা গ্রামের কৃষক ছাইদুল ইসলাম। খাল খননের বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আঙগর (আমাদের) জমি আছে এখানে, আর যাদের জমি নাই, তারা এখানে সদস্য হইছে হুনতাছি। এইটা বাটপারি ছাড়া কিছু না। কয়ডা টাউট-বাটপারে এ কাজের জন্য চেষ্টা করতাছে। ভাই কি আর কমু- আমার সন্তানেরা স্কুলে পড়ালেহা (পড়াশোনা) করে। তাদের লেখাপড়া, সংসারসহ সব খরচ আমি ১০ কাঠা জমি থেকে জোগাড় করি। আমার এই জমিডা যদি খাল হয়ে যায়, তা হলে আমি কীভাবে চলব! তাই সরহারের (সরকার) কাছে অনুরোধ, এই খালের দরহার (দরকার) নাই।’
আরেক কৃষক আব্দুল হামিদ বলেন, ‘এ জমির কাগজপত্র আমাদের। কীভাবে আমাদের সঙ্গে কথা না বলে খাল খননের উদ্যোগ নেয়! এখানে কিছু টাউট-বাটপার লেগেছে এই খাল খননের পিছনে। আর এসব টাউট-বাটপারের কাজই হলো গরিবের হক নষ্ট করা। এখানে খাল হলে আমাদের তিন ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হবে।’
বন্দটেকী এলাকার কৃষক আব্দুল লতিফ বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে এখানে এমনেই পানি থাকে। আর শুষ্ক মৌসুমে সরিষা, গম, ভুট্টা, বেগুন, আলু, টমেটো গাজরসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ হয়। আর এগুলোই বিক্রি করে আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ সংসার চালায়। যদি এখানে খাল খনন হয়, তা হলে জমি নষ্ট হবে, আমাদের আবাদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। মূলকথা, সরকারের টাকা নষ্ট হবে। কারণ, এই খাল অহেতুক।’
চন্দ্রকোণা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার আব্দুস সোবহান বলেন, ‘এখানে খাল খনন করা হলে তা গ্রামবাসীর কোনো উপকারে আসবে না। উল্টো ৪/৫ হাজার মানুষ ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হবে। তাই সাধারণ কৃষকদের কথা চিন্তা করে খাল খনন বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি।’
তবে উল্টো কথা বলছেন চন্দ্রকোণা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান গেন্দু। তিনি বলেন, ‘এই খাল খনন হলে স্থানীয় কৃষকদের উপকার হবে। এই খালে সব সময় পানি থাকবে। এই পানি ধানসহ বিভিন্ন আবাদে সেচকাজে ব্যবহার করতে পারবে।’
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই খালটি প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো। এটি এখন ভরাট হয়ে গেছে। স্থানীয়রা হয়তো সেখানে চাষাবাদ করেন। সরকার এটি খনন করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা সবার সার্বিক সহযোগিতা চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাজ এখনো শুরু হয়নি। উদ্যোগ যদি বাস্তবসম্মত হয়, যদি ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হয়, তা হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। আর যদি লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়, তা হলে প্রকল্প বাতিল করা হবে। আমরা অবশ্যই স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে কাজ শুরু করব। এখনো আলোচনা করার সুযোগ আছে।’