গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হাওড়া নদী। নদীতে জল থাকলেও এখন স্রোত নেই। ভাঙা-গড়ার সুনামও নাকি হারিয়েছেন সেই কবে। নদীর কূল ঘেঁষেই দোচালা টিনের সারিবদ্ধ কয়েকটি ঘর। বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করতেই দেখা যায় উঠানে বসে নারী-পুরুষ আপন মনে কাজ করছেন। কেউ বাঁশ থেকে বেত তুলছেন। আবার কেউ সেই বেত দিয়ে নিপুণ হাতে ঝুড়ি বুনছেন। সবাই কাজে ব্যস্ত থাকলেও তাদের মুখটা মলিন। যেন কালের বিবর্তনে ঐতিহ্য ও গৌরব হারানো সেই হাওড়া নদীর মতো।
এমন দৃশ্য দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের দরুইন গ্রামে। এ পেশায় যারা কাজ করেন, তারা সবাই হিন্দুধর্মাবলম্বী নমঃশূদ্র বর্ণের। স্থানীয়দের কাছে সবাই ঝুড়ি বানানোর কারিগর হিসেবেই বেশি পরিচিত।
বাড়ির উঠানে বসে বাঁশ থেকে বেত তুলছেন মন্টু নমঃশূদ্র। হাতের কাজ বন্ধ না করেই তিনি বলেন, ‘বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করে এখন আমাদের সংসার চালাতে পারি না। নানা সমস্যায় এখন আমরা জর্জরিত। কাঁচামালও এখন আর আগের মতো সহজে পাওয়া যায় না। বাঁশ কিনতে হয় চড়া দামে। ক্রেতাও অনেক কমে গেছে। বাপ-দাদার পেশা। তাই ছাড়তে পারছি না। কোনো রকমে আঁকড়ে ধরে আছি। ভবিষ্যৎ নেই জেনে এখনকার ছেলেরা অন্য কাজ বেছে নিচ্ছে। আমার ছেলেও আমাদের দেখে ঝুড়ি বোনার কাজ শিখেছিল। কাজ না থাকায় এখন বাধ্য হয়েই সে এক ওষুধের দোকানে মাসিক বেতনে কাজ করে। বাপ-ছেলে মিলে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসারটা চলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা বাঁশ স্থানীয় বাজার থেকে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। তা দিয়ে সাতটি ঝুড়ি বানানো যায়। সারা দিনের শ্রম আর খরচের হিসাবে মেলে না।’
উঠানে বসে এক মনে বাঁশের বেত দিয়ে ঝুড়ি বুনছেন রাধা রানী নমঃশূদ্র। তিনি বলেন, ‘ঝুড়ির চাহিদা নেই বললেই চলে। আগে দিনে ৮ থেকে ১০টা ঝুড়ি তুলতাম। হাতে কাজ থাকত। এখন দিনে মাত্র একটা, বেশি হলে দুইটা তোলা হয়।’
নেপাল সরকার নামে এক বৃদ্ধা জানান, ‘আগে পরিবারের সবাই মিলে ঝুড়ি তৈরির কাজ করতাম। আয় ছিল ভালো। ঝুড়ি নিতে পাইকাররা বাড়িতে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। সেই সময় এখন আর নেই।’
প্রদীপ নমঃশূদ্র নামের এক যুবক বলেন, ‘আমরা বর্তমানে এখানে ২০ ঘর আছি। তারা বাঁশ-বেতের কাজ করি। একটা সময় ছিল আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রচুর মাছ রপ্তানি হতো। স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা মাছ প্যাকেট করার জন্য আমাদের এখান থেকে ঝুড়ি কিনে নিতেন। তারপর সেই ঝুড়িতে মাছ ভরে রপ্তানি করা হতো। আগে ঝুড়ির অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখতেন। মাছ রপ্তানি কমে যাওয়ায় ঝুড়ির চাহিদাও কমে গেছে। এই ঝুড়ির স্থানীয় বাজারেও তেমন চাহিদা নেই।’
জীবন নমঃশূদ্র নামের আরেক কারিগর বলেন, ‘বাঁশসহ কাঁচামালের দাম অনেক বেড়েছে। এলাকায় সব সময় বাঁশ পাওয়া যায় না। প্রতিটি ঝুড়ি আগে ১০০ টাকা বিক্রি করতাম। এখনো ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ বাজারে সব জিনিসের দাম অনেক বেশি। কুলিয়ে উঠতে না পেরে অনেকেই অন্য কাজ বেছে নিয়েছে। যারা টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, তারা অনেক কষ্টের মধ্যে আছে। সরকারিভাবে যদি আমাদের সহযোগিতা করা হতো, অন্তত খেয়ে এ পেশা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম।’
পৌর শহরের বড় বাজারের ফরহাদ হোসেন নামের এক মাছের আড়তদার বলেন, ‘আগে অনেক বেশি মাছ রপ্তানি হতো। তাই ঝুড়ির চাহিদা ছিল অনেক বেশি। মাসের শুরুতেই তাদের ঝুড়ির চাহিদা জানিয়ে রাখা হতো। এখন মাছ রপ্তানি কমে যাওযায় ঝুড়ির চাহিদাও কমে গেছে।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাবেয়া আক্তার বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী এসব ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকারিভাবে চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। কেউ ক্ষুদ্র ঋণ নিতে চাইলে সহযোগিতা করা হবে।’