একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি। বৃহস্পতিবার এক দিনের ছুটি নিলে সাপ্তাহিক ছুটিসহ দাঁড়ায় টানা চার দিনের ছুটি। এই ছুটিকে কেন্দ্র করে পর্যটকের ঢল নেমেছে সৈকত-শহর কক্সবাজারে। বালিয়াড়িতে ভিড় করেছেন লাখো পর্যটক। বালিয়াড়ির সামনে নীল জলরাশিতেও মানুষের ভিড়। বিশাল বালিয়াড়ি ও নোনাজলে সবাই মেতেছেন বাঁধভাঙা আনন্দ-উল্লাসে।
সব মিলিয়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। তবে অনেকেই হোটেলে রুম না পেয়ে লাগেজ নিয়ে অবস্থান করছেন বালিয়াড়ির কিটকটে। অনেক ভ্রমণপিপাসু বলছেন, সন্ধ্যা হলেই কক্সবাজার ছাড়বেন। আর সাগর উত্তাল হওয়ায় পর্যটকদের সমুদ্রস্নানে সতর্ক অবস্থানে লাইফগার্ড কর্মীরা।
সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে দেখা যায়, পর্যটকরা পানিতে নেমে গোসল করছেন। অনেকেই বালুচরে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত। কেউ দ্রুতগতির জেডস্কি নিয়ে নীল জলের বিশাল সমুদ্রে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছেন। আবার কেউ মুগ্ধ হচ্ছেন ঢেউয়ের তালে ছেলেমেয়েদের সমুদ্রস্নানের দৃশ্য দেখে।
পর্যটক শামীম ও নাসরিন দম্পতি বলেন, ‘টানা ছুটি পেয়ে কক্সবাজারের ছুটে আসা। কক্সবাজারই আমাদের কাছে ঘুরে বেড়ানো প্রিয় স্থান। খুব ভালো লাগে এখানে। বিশেষ করে ইনানী হিমছড়ি তো সবার আগে যেতে হবে। এ দুই স্থান আমাদের খুব প্রিয়।’
রিয়াদ নামে আরেক পর্যটক বলেন, ‘ছুটি পেয়েছি, তাই কক্সবাজারে চলে এসেছি। এখানকার অপরূপ প্রকৃতি খুব ভালো লাগে, কাছে টানে। ফলে ছুটির সময়টা এখানে পাহাড়, সাগর ও প্রকৃতি উপভোগ করব।’
এদিকে পর্যটকের আগমনে ব্যস্ত সময় পার করছেন সৈকতের ফটোগ্রাফার, ঘোড়াওয়ালা, জেডস্কি ও বাইকচালকরা। ফটোগ্রাফার কামাল উদ্দিন বলেন, ‘বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। পর্যটকদের ছবি তুলে ভালো আয়ও হচ্ছে। আশা করি, আরও দু-এক দিন ভালো ব্যবসা করা যাবে।’
জেডস্কিচালক রহিম মিয়া বলেন, ‘বুধবার (গতকাল) সকাল থেকেই সৈকতে হাজার হাজার পর্যটক। এ মৌসুমে মনে হয় সবচেয়ে বেশি পর্যটক এই সময়ে এলেন। পর্যটকরা জেডস্কিতে চড়ে সাগর উপভোগ করছেন। ফলে আমাদের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে।’
এদিকে তিন দিনের টানা ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল নামায় হোটেল-মোটেলগুলোতে ঠাঁই মিলছে না। অনেকেই হোটেলে কক্ষ ভাড়া না পেয়ে সমুদ্রসৈকত ও সড়কে পায়চারী করছেন। পর্যটকদের অভিযোগ, হোটেল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, যানবাহনসহ সবখানে বাড়তি ভাড়া ও অসদচারণের শিকার হওয়ার পাশাপাশি চরম হয়রানিতে পড়ছেন তারা। এসবের জন্য দালাল চক্রকে দুষছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তবে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে পর্যটকদের হয়রানি নিরসন করা হবে বলে জানিয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
সাপ্তাহিক ও একুশে ফেব্রুয়ারির চার দিনের ছুটিতে তাদের পদচারণে মুখর সাগরতীরসহ পর্যটন স্পটগুলো। শুধু হোটেল, বালিয়াড়ি কিংবা সাগরতীর নয়; অনেক পর্যটক ইনানী, সেন্ট মার্টিন, হিমছড়ি, রামুর রামকোট, পাটুয়ারটেক সৈকত দেখতেও ভিড় জমাচ্ছেন।
সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে হোটেলে রুম ভাড়া না পেয়ে ব্যাগ ও লাগেজ নিয়ে অবস্থান করছেন বালিয়াড়িতে। আবার অনেক পর্যটক অবস্থান করছেন সাগরতীরে। ভ্রমণে এসে অনেক পর্যটক হোটেল রুমের জন্য ঘুরছেন। কেউ চাচ্ছেন অতিরিক্ত ভাড়া। পর্যটকদের অভিযোগ, তারা হয়রানি শিকার হচ্ছেন।
সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে ব্যাগ ও লাগেজ নিয়ে অবস্থান করা পর্যটক ইলিয়াছ উদ্দিন বলেন, ‘হোটেলের রুম আগে বুকিং করিনি। হঠাৎ করে পাঁচজনের একটি টিম কক্সবাজারে ছুটে এলাম। কিন্তু সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হোটেল-মোটেল জোনে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু কোনো রুম ভাড়া পাইনি। ফলে এখন সাগরের বালিয়াড়িতে অবস্থান করছি।’
প্রধান সড়কে সুগন্ধা পয়েন্টের মোড়ে অবস্থান নেওয়া পর্যটক রায়হান কবির বলেন, ‘গত সোমবার হোটেল সানসেট রিসোর্টে ১ হাজার ২০০ টাকায় রুম ভাড়া নিয়ে ছিলাম। কিন্তু মঙ্গলবার রুম থেকে বের করে দিয়েছে। রুমের ভাড়া দ্বিগুণ দিতে চেয়েছিলাম তাও দেয়নি। পরে দেখলাম ১ হাজার ২০০ টাকার ওই রুম তারা ৪ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছে।’
পর্যটক শুক্কুর, কাইয়ুম ও ছৈয়দ বলেন, ‘সি ল্যান্ড গেস্ট হাউসে একটি রুম ভাড়া চেয়েছিলাম। তারা এক দিনের জন্য ৬ হাজার টাকা চেয়েছে।’
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি সেলিম নেওয়াজ জানান, কক্সবাজার সৈকতের নিকটবর্তী পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলে কোনো রুম খালি নেই। হোটেলের কক্ষ খালি না পেয়ে অনেকে ছুটছেন শহরের দিকে। অতিরিক্ত দাম আদায়ের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার জানা নেই। তবে যেসব হোটেলের বিরুদ্ধে পর্যটকরা অভিযোগ করবেন, প্রমাণ মিললে তাদের সদস্যপদ বাতিল করা হবে।’
এদিকে সাগর কিছুটা উত্তাল। বেড়েছে ঢেউয়ের পরিধি। তাই সমুদ্রস্নানে পর্যটকদের নিরাপত্তায় সচেতনতার পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে লাইফগার্ড কর্মীরা।
সি সেফ লাইফগার্ড সংস্থার ইনচার্জ মোহাম্মদ ওসমান বলেন, ‘আবহাওয়া খারাপ থাকায় পর্যটকদের সৈকতে গোসলে সতর্ক করা হচ্ছে। আর এত মানুষ একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই কঠিন। তাই আমাদের সব সদস্য একযোগে কাজ করছেন। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আমরা সক্রিয় রয়েছি।’
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পয়েন্ট, পর্যটন স্পট ও বালিয়াড়িতে ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। ফলে আগত পর্যটকরা নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। সুতরাং যেখানে পর্যটকরা হয়রানির শিকার হবেন; অভিযোগ পাওয়ামাত্র সেখানে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে সমন্বয় করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আগামী শনিবার পর্যন্ত টানা ছুটিতে কক্সবাজারে পাঁচ লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম হবে বলে জানিয়েছেন পর্যটনসংশ্লিষ্টরা।
এমএ/