![তাদের মৃত্যুর সঙ্গে মারা যাবে ভাষাটি](uploads/2024/02/28/1709097952.10.-kharia.jpg)
প্রতিবছর নানা দিবস আসে, চলে যায়। ভাষা দিবসও চলে গেল। বাঙালি জাতির জীবনে শোকাবহ, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে চিরভাস্বর এই ভাষা দিবস। তখন ভাষা নিয়ে চলে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। এর এক বিশাল অংশজুড়ে থাকে আমাদের নিজস্ব মাতৃভাষার কথা।
মানুষের প্রয়োজনে মাতৃভাষার জন্ম হয়েছিল, আবার হারিয়েও যাচ্ছে অন্য ভাষার আধিপত্যে টিকতে না পেরে। নিজ নিজ ভাষার মাধুর্য অন্যরকম। যেখানে আছে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য ও রসবোধ, রয়েছে নিজস্ব অহংকার। খাড়িয়া এমনি এক ভাষা। বাংলাদেশে বর্তমানে এ ভাষায় কথা বলতে পারেন কেবল দুই বৃদ্ধা বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা। তাদের মৃত্যু হলে খাড়িয়া ভাষারও মৃত্যু ঘটবে। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা ও একটি সংস্কৃতি।
ভেরোনিকা ও খ্রিস্টিনার মুখেই কেবল খাড়িয়া ভাষাটি টিকে আছে এদেশে। তাদের বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছড়া বস্তিতে। ভেরোনিকা কেরকেটা বলেন, ‘নিজের ভাষায় কথা বলার লোক পাই না বলে দুঃখ হয়। আমরা দুই বোন ছাড়া দেশে আর কেউ এ ভাষায় কথা বলতে পারে না।’
খ্রিস্টিনা কেরকেটা বলেন, ‘ইচ্ছে তো করে নিজেদের ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলি। কিন্তু উপায় নেই। আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির সঙ্গে কথা বলতে হয় বাংলা ভাষায়।’
খাড়িয়া ভাষা রক্ষার উদ্যোক্তা পিউস নানোয়ার বলেন, ‘২০১৭ সালে বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার নামে একটি খাড়িয়া ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র খুলে তরুণ প্রজন্মকে ভাষা শেখানোর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টায় কোনো সফলতা পাইনি। কারণ, বাংলাদেশে খাড়িয়াদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই।’
পিউস নানোয়ারের দেওয়া তথ্য মতে, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের কয়েকটি চা-বাগানে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস। ২০২০ সালে এক জরিপে দেশে এ জনগোষ্ঠীর ৫ হাজার ৭০০ জনের তালিকা করা হয়। অনুসন্ধানে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছাড়া আর কোথাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করা আহমদ আফরোজ বলেন, ‘এই দুই বোন ছাড়া দেশে আর কেউ পূর্ণাঙ্গভাবে খাড়িয়া ভাষা বলতে পারেন না। তারা হারিয়ে গেলে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই মাতৃভাষা খাড়িয়া।’
চা-শ্রমিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করা শিক্ষক দীপংকর শীল জানান, চা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ অতি দরিদ্র হওয়ায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চা সম্ভব হয় না। পাশাপাশি কোনো ভাষার জনসংখ্যা কম হলে সহজেই সেই ভাষা হারিয়ে যায়। তবে বিপন্ন ভাষার গান, আবৃত্তি রেকর্ড করে সংরক্ষণ করতে পারলে কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব।
ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যরা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে লোক গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, ‘ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীরা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের সংগঠিত করে এদের জীবনচর্চা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে লালনের মাধ্যমে রক্ষা করা যেতে পারে। এদের রক্ষা করতে না পারলে আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্র্যও এক দিন হারিয়ে যাবে।’
জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার ৭টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংকটে রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি, প্রথা, ইতিহাস ও উৎসব বাঙালিদের মুগ্ধ করলেও চর্চা এবং সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা। এরমধ্যে দেশের ১৬৮টি চা-বাগানের মধ্যে ৯০টিরই অবস্থান মৌলভীবাজারে। এসব বাগানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। তাদের অধিকাংশই পাহাড় টিলার পাদদেশে, বনজঙ্গলে কিংবা সমতলভূমিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনযাপন করছেন। চা-শিল্পের সঙ্গে জড়িত এসব নৃগোষ্ঠীর জাতীয় অর্থনীতিতে আছে যথেষ্ট অবদান। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমির অধিকারসহ মাতৃভাষা রক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে এই জনগোষ্ঠী।