![মানিকগঞ্জে ফসলি জমি কেটে রাস্তা নির্মাণ](uploads/2024/04/02/1712029584.Manikganj-Road-Story.jpg)
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়ন। ওই এলাকার ডুমুরখোলা গ্রামের কৃষক আশেক আলী বিশ্বাসের ৬২ শতাংশ ফসলি জমি রয়েছে। সারা বছর এসব জমিতে চাষাবাদ করে তিনি সংসার চালান। সম্প্রতি তার জমির পাশ দিয়ে একটি সড়ক তৈরি হচ্ছে। এতে তিনি টাকার অঙ্কে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক অনুরোধ করেও ঠিকাদারের রক্তচক্ষু থেকে তিনি নিস্তার পাননি।
প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার জমির পাশ দিয়েই ঝিটকা পোদ্দারবাড়ি থেকে মহিষাখোলা সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রায় আড়াই কিলোমিটারের এই সড়কে আমার অন্তত ২০ শতাংশ ফসলি জমি পড়েছে। আমি ঠিকাদার হানিফ ভাইকে বলেছিলাম, মাটি যখন নেবেনই তাহলে একপাশ থেকে বেশি করে নেন। কিন্তু তিনি তা মানেননি। আমার জমির দুই পাশ থেকে মাটি কেটেছেন। এতে আমার প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। আমার এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’
নির্মাণাধীন ওই সড়কের মধ্যবর্তী সুরাই গ্রামের কৃষক বাবুল আখতার। তার জমিও রাস্তাটির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলেন, ‘রাস্তার পাশে আমার ২০ শতাংশ জমি আছে। ঠিকাদার আমাকে বললেন, রাস্তার জন্য মাটি দিতে হবে। আমি তাকে বললাম, আমার এই জমির পাশেই পাঁচ শতাংশের আরও একটি জমি আছে। সেখান থেকে মাটি নেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। ওখান থেকে মাটি নেওয়ার জন্য উল্টো শ্রমিক খরচ দাবি করেছেন।’
প্রায় তিন কোটি টাকার এই সড়ক নির্মাণের শুরুতেই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সড়কের জন্য প্রায় ৩৯ লাখ টাকার মাটি বরাদ্দ থাকলেও কাটা হচ্ছে কৃষকের তিন ফসলি জমি। নিয়মবহিভূর্তভাবে মাটিকাটা বন্ধে ভুক্তভোগী কৃষকরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলজিইডি জিডিপি-৩ প্রকল্পের আওতায় হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের ঝিটকা পোদ্দারবাড়ি থেকে মহিশাখোলা পর্যন্ত ২৩৬০ মিটার সড়ক সংস্কারের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। দুই কোটি ৯৮ লাখ ৯১২ টাকার চুক্তিমূল্যে কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ঠিকাদার মোহাম্মদ হানিফ। সড়কটির সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের জুন মাসে। বর্তমানে সড়কটিতে চলছে মাটি ভরাটের কাজ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার ঝিটকা পোদ্দারবাড়ি থেকে মহিশাখোলা পর্যন্ত ২৩৬০ মিটার সড়কটির কাজ চলতি বছরের মার্চের প্রথম দিকে শুরু হয়। দরপত্রে মাটি ভরাটের জন্য প্রায় ৩৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর পরও ঠিকাদার সড়কের দুপাশের কৃষি জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটছেন। রাস্তার মাঝখানে বালু দেওয়ার কথা থাকলেও দেড় থেকে দুই ফুট জায়গা মাটি ভরাট করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা কৃষকরা বাঁধা দিলেই তাদেরকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী ঠিকাদার হানিফের কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্থানীয় শতাধিক পরিবার। কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে ও ঠিকাদারের স্বেচ্ছাচারিতায় সড়কটি নির্মাণে এসব অনিয়ম হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
ওই এলাকার কৃষক রশিদ মিয়া বলেন, ‘রাস্তার পাশে আমার ১৮ শতাংশ জমি আছে। ওখানে আমি মরিচ চাষ করেছি। কিন্তু প্রায় তিন শতাংশ জায়গার মরিচ গাছ নষ্ট করে মাটি ফেলা হয়েছে। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের রাস্তা দরকার আছে। কিন্তু এভাবে ফসলি জমি কাটায় আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
স্থানীয় কৃষক মোহাম্মদ গোলাপ দাবি করেন, ‘এই রাস্তার জন্য আমাদের এলাকার আড়াই খেকে তিন শ বিঘা জমি কাটা পড়বে। আমরা নিরীহ কৃষক। অন্যের জমিতে খেটে ১১ শতাংশ জায়গা কিনে বাড়ি করছি। এখন আমার ওই বাড়ি থেকে মাটি কেটে রাস্তায় দিতে হবে। এভাবে চললে আমরা যাব কোথায়।’
ঠিকভাবে কাজ করতে বলায় ঠিকাদার হানিফ ভয়ভীতি দেখিয়েছেন জানিয়ে ওই এলাকার কৃষক আব্দুস ছালাম বলেন, ‘বিষয়টি আমি এলজিইডি ও উপজেলা প্রকৌশলীকে জানানোর পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।’
মানিকগঞ্জে পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন অ্যাডভোকেট দীপক কুমার ঘোষ। তিনি বলেন, ‘কারও কৃষিজমি জোর করে বা ভয় দেখিয়ে কোনো প্রকল্পের কাজে লাগানো অন্যায়। আমরা চাই প্রকল্পগুলো লিখিত বর্ণনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হোক। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো।’
ফসলি জমি কাটার বিষয়টি স্বীকার করে ঠিকাদার হানিফ দাবি করেন, ‘রাস্তার পাশে যাদের জমি আছে তাদের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ স্বেচ্ছায় মাটি দিচ্ছেন। যাদের জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে সেগুলো পরে বালু দিয়ে ভরাট করা হবে।’ সাধারণ কৃষকদের ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়টি অস্বীকার করলেও মাটির জন্য সরকারি বরাদ্দ থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। বরাদ্দ থাকার পরও কেন কৃষকদের মাটি কাটা হচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান বলেন, ‘উপজেলার পোদ্দারবাড়ি থেকে মহিশাখোলা সড়কটি এলজিইডির আইডিভুক্ত একটি রাস্তা। যদি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো অনিয়ম করে থাকে তদন্তসাপেক্ষে শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এ বি এম খোরশেদ আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাস্তাটি আমাদের আওতাধীন। এটির কাজ জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। সড়ক নির্মাণকাজে কোনো অনিয়ম হলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’