তালেবান কর্মকর্তারা আফগানিস্তানের শুষ্ক উত্তরাঞ্চলে নির্মাণাধীন একটি নতুন খালের কথা বলা শুরু করেছেন। সম্প্রতি ইউটিউবে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, উজ্জীবিত খননকারীরা বালির টিলার ওপর হাঁকডাকে কাজ শুরু করেছেন এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শ্রমিকরা একসঙ্গে পরিশ্রম করছেন। ইসলামপন্থি সরকার বলছে, প্রায় ৫ হাজার ৫০০ লোক এই প্রকল্পে ৩ হাজার ৩০০ বিটের বেশি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। একবার সম্পূর্ণ হলে কোশ টেপা খালটির মাধ্যমে সেচের জন্য আমু দরিয়া নদী থেকে পানি আনা হবে।
তালেবানদের প্রত্যাশা, প্রকল্পটি ৫ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর মরুময় ভূমিকে কৃষিজমিতে পরিণত করবে, যা দেশটির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ কারণে নতুন এই প্রকল্পে আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির হাতছানি দেখছেন বিশ্লেষকরা। খবর দ্য ইকোনমিস্ট ও ওয়াশিংটন পোস্টের।
আমু দরিয়া একসময় অক্সাস নামে পরিচিত ছিল। এটি মধ্য এশিয়ার দীর্ঘতম একটি নদী। নদীটি আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানের মধ্য দিয়ে গিয়ে উজবেকিস্তানে প্রবাহিত হয়েছে।
আফগানিস্তানের খুব ভয়ানক সংবাদের মধ্যে একটি হলো, দেশটির চার কোটি জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাই দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ কারণে তালেবান সরকারের শাসন করার সক্ষমতার একটি উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা হলো খালটি।
ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের প্রধান আবদুল রহমান আত্তাশ ঘোষণা করেছেন, ‘অনেকে সন্দেহ করে যে আমাদের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষমতা আছে কি না। আমরা প্রমাণ করব, আফগানিস্তান তার অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে পারে এবং নিজস্বভাবে জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে।’
ইকোনমিস্ট বলছে, আফগানরা এখন পর্যন্ত তেমন কিছু করতে পারেনি। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার পর থেকে দেশটিকে একটি অর্থনৈতিক সংকট আঁকড়ে ধরেছে। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং দেশটির নির্ভরশীল আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাব। বিশ্বব্যাংক মনে করে, ২০২১ সালে দেশটির অর্থনীতির ২০ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয়েছে। মারত্মক খরা ও অস্বাভাবিক শীতের কারণে এই সংকট দুই কোটি মানুষকে তীব্র ক্ষুধার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং, যা বিশেষ করে আধা-শুষ্ক মধ্য এশিয়ায় দেখা যায়, ইতোমধ্যে তা পিানির প্রাপ্তিকে একটি জরুরি উদ্বেগের কারণ করে তুলেছে। আফগানিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি আশরাফ ঘানি, সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইরানের সীমান্তের কাছে একটি বাঁধ নির্মাণ শেষ করার পর আনন্দিত হয়েছিলেন।
সেন্টার অন আর্মড গ্রুপ নামের একটি এনজিওর সঙ্গে কাজ করা এশলি জ্যাকসনের মতে, তালেবানরা একইভাবে কোশ তেপা খাল ব্যবহার করে ‘স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা ও শক্তি’ প্রদর্শন করছে।
ব্রিটিশ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ইকোনমিস্ট বলছে, প্রকল্পটি নতুন নয়। উত্তর আফগানিস্তানে একটি খালের পরিকল্পনা কয়েক দশক ধরে আলোচনায় রয়েছে। এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল, দেশটির সাবেক আমেরিকান-সমর্থিত সরকারের অধীনে। তবে বর্তমানে তালেবানের অগ্রগতি আরও আকর্ষণীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। প্ল্যানেট ল্যাবস, পিবিসি নামের আমেরিকান একটি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা স্যাটেলাইটচিত্রে দেখা গেছে, গত ১০ মাসে ১০০ কিলোমিটারের বেশি খাল খনন করা হয়েছে।
তবে দ্রুতগতির কাজ আসলেই ভালো নয়। জার্মানিতে থাকা একজন আফগান প্রকৌশলী নাজিবুল্লাহ সাদিদ এই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যে খালটি সারিবদ্ধ বা আচ্ছাদিত হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে খালের বেশির ভাগ পানি এই অঞ্চলের শুষ্ক ও বালুকাময় মাটিতে হারিয়ে যাবে (শুষে নেবে)। এ ছাড়া খাল নির্মাণের সবচেয়ে সহজ অংশ হলো খন্দন করা। সাদিদ সন্দিহান যে, তালেবানরা কালভার্ট, সেতু নির্মাণসহ জটিল প্রকৌশলকাজ পরিচালনা করতে পারে, যা আরও পরে করা উচিত। কিন্তু তারা তাড়াহুড়ো করছে বলে মনে করেন সাদিদ।
এদিকে খালের অর্থায়নও সহজ হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। খবরে বলা হয়, আফগানিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ হলো, এটিতে (খাল খনন) দেশীয় রাজস্ব থেকে অর্থ সংকুলান করা হবে, যা কর পরিহার ও দুর্নীতির পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদের দাবিদার। এর সামান্য একটি বিকল্প আছে, সেটি হলো বিদেশি অর্থায়ন।
তবে ইকোনমিস্টের খবরে বলা হয়, বিদেশি দাতারা তালেবানদের কাছে বিশাল প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগের জন্য লাইন দিচ্ছে না, যখন দেশটির সরকার জনজীবন থেকে নারী ও মেয়েদের নিষিদ্ধ করছে। তবু খালের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৮৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মধ্যে প্রথম ধাপ, তথা ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য ৮২০ কোটি (৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন) আফগানি (৯ কোটি ১০ লাখ ডলার) খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের ব্যয় ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ৮ শতাংশের সমতুল্য।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, খালটি সম্পূর্ণ হলে আঞ্চলিক সংঘর্ষ বাড়তে পারে। এটির কারণে উজবেকিস্তানের সীমান্তের কাছাকাছি আমু দরিয়া থেকে পানি সরে যাবে। উজবেকিস্তানের মানুষ তাদের বৃহত্তম কর্মসংস্থানের উৎস তুলার খেতে সেচ দেওয়ার জন্য নদীটির ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া আফগানিস্তান উজবেকিস্তান থেকে তার বেশির ভাগ বিদ্যুৎ আমদানি করে, তাই দেশটির বিরোধিতা করার সামর্থ্য তাদের নেই। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কাবুলের বাসিন্দাদের দিনে মাত্র ২ ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল। কারণ তাসখন্দের সরকার আফগানিস্তানে রপ্তানি কমিয়ে নিজের দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি সামাল দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির ওপর ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা, দুই দেশের মধ্যে একটি কঠিন সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলবে।