বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতে রপ্তানি কমেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালিতে রপ্তানি কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির পতন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
এর মধ্যে আবার অন্য বাজারগুলোতেও রপ্তানি কমে যাওয়ায় নতুন করে ভাবতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। মূলত যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় ক্রয় আদেশ কমছে বলে মনে করেন রপ্তানিকারকরা। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান এই খাতের রপ্তানি বাড়াতে গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
পাঁচ মাসের ব্যবধানে আবারও রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা কমিয়েছে সরকার। গত রবিবার এক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক এ তথ্য জানিয়েছে। একাধিক খাতের রপ্তানিকারক বলছেন, একদিকে ব্যবসার খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে প্রণোদনা কমছে। এতে পণ্য রপ্তানিতে দেশীয় কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। তাতে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার শঙ্কা আছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে সার্বিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত এবং যুক্তরাজ্য ও নতুন বাজারে দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। তবে বেশ কয়েকটি বড় বাজারে রপ্তানি কমেছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার জার্মানি ও ইতালি। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জার্মানির বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নেমেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে দেশটিতে আগের অর্থবছরের তুলনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। এ সময়ে জার্মানির বাজারে ৫৪২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে ইতালির বাজারে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৯৩ কোটি ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ কম।
ইইউর পরিসংখ্যান অফিস ইউরোস্ট্যাটে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের তুলনায় এ বছরের একই সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আমদানি প্রায় ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমিয়েছে ইইউ। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, গত মে মাসে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৩৫ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের থেকে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালিতে নয়, বরং নতুন বাজার ভারতেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে ভারতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এটা কমে যাওয়ার পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু কারণ রয়েছে। আর তা হলো গ্যাস ও বিদ্যুতের চরম সংকট। এই সংকটের কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ক্রেতাদের কাছে যথাসময়ে পোশাক পাঠানো যাচ্ছে না। এ কারণে তারা বাংলাদেশের কোম্পানির পরিবর্তে অন্য দেশ থেকে পোশাক কিনছে। কাস্টমসের হয়রানির ফলেও শিপমেন্ট বিলম্বিত হচ্ছে। এটাও রপ্তানি কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ।
সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর চরম অসহযোগিতাও চলছে। সময়মতো ব্যাক টু ব্যাক এলসি করছে না। এ ছাড়া ক্রেতা দেশগুলোর কাছ থেকে আমরা পণ্যের যথার্থ দাম পাচ্ছি না। কারণ শ্রমিকদের বেতনের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা পোশাকের দাম বাড়াচ্ছে না। তারা যে দাম দিচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে আমরা সে দামে ক্রয় আদেশ নিতে পারছি না। এসব সমস্যার কারণে রপ্তানি কমেছে বলে মনে করছেন তারা।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মো. রেজাউল আলম খবরের কাগজকে বলেন, রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। এই মন্দার কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই রপ্তানি কমছে। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সে কারণে আমাদের পোশাক রপ্তানি কমেছে। এটা সত্য যে, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে লিড টাইম বেড়ে গেছে। সে কারণে আমাদের কিছু ক্রেতা অন্য দেশে চলে গেছে।
তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি বাড়াতে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ খাতে বিদেশি ক্রেতা আকৃষ্ট করতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট কমিয়ে আনতে হবে। কাস্টমস এবং ব্যাংকের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান এই খাতকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। সম্ভাবনাময় খাতটি আরও গতিশীল হোক, সেটিই প্রত্যাশা।