ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় সিলেট বিভাগের তিন জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সাড়ে ২৩ লাখ মানুষ। সিলেট ও মৌলভীবাজারের প্রায় অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া নেত্রকোনা, গাইবান্ধা ও নীলফামারীও প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা। অসংখ্য মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
সড়ক-মহাসড়কে পানি উঠে স্থল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে খেতের ফসল, ভেসে গেছে চাষের মাছ। ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল হারিয়ে দিশেহারা মানুষ। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ।
প্রতিবছরই সিলেটবাসীকে বন্যাকবলিত হয়ে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত সিলেট মহানগরীর ২৩টি ওয়ার্ডসহ জেলার ১৩০টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট মহানগরীতে বন্যাকবলিত হয়েছে ৫৫ হাজার মানুষ। ইতোমধ্যে সিলেট বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেট বিভাগের বন্যায় আক্রান্ত এলাকার উজান আর ভাটি- দুই জায়গাতেই দ্রুত বনভূমি উজাড় হচ্ছে। গভীর নদ-নদী অনেকখানি ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারছে না। প্রাকৃতিক পানির আধারগুলো ভরাট হয়ে সেখানে বসতি ও শহর গড়ে উঠেছে। আর হাওরের পানি নামার জায়গাগুলো সংকুচিত হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত উজান থেকে নেমে এসে সিলেট শহর ভাসিয়ে দিচ্ছে।
সিলেটের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় জরুরি নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেছেন, দেশের কয়েক জায়গায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় ডায়রিয়া এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ওষুধ মজুত রাখতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে, বন্যার সময় এবং বন্যা-পরবর্তী রোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।
বন্যার পানির মাধ্যমে শিশুর শরীরে রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এ সময় শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে শিশুর খাবারের প্রতি। বন্যার সময় সাপসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যেতে পারে। এ ধরনের সমস্যা থেকে বাঁচতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের আবহাওয়া পরিস্থিতি প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে পড়েছে এবং এর অন্যতম শিকার আমরা। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিবেশী ও উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে কার্যকর আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে। বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যও প্রস্তুতি রাখতে হবে।
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ বন্যার প্রকোপ কমাতে নদ-নদীসহ সব জলাধারের পানি ধারণক্ষমতা, অর্থাৎ গভীরতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তবে এই মুহূর্তে বন্যার্তদের ত্রাণ-সহায়তা বেশি প্রয়োজন। খাদ্য, বস্ত্র, বিশুদ্ধ পানি, খাওয়ার স্যালাইনের অভাবে বন্যার্তরা দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছে। সরকার শুধু নয়, সমাজের বিত্তবানরা সামর্থ্যানুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারেন।
এ ছাড়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকসহ সামাজিক সংগঠন ও সমাজের বিত্তবানদেরও উচিত বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো। সবার প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারলে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করা অনেকটাই সহজ হবে।