আমি একাত্তরে ফেনী কলেজের প্রথম বর্ষের এইচএসসির ছাত্র ছিলাম। আমার বাবা আবদুল মালেক আওয়ামী লীগের ফেনী মহকুমা কমিটির সহসভাপতি ও ফেনী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। তখন ফেনী মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন জননেতা খাজা আহাম্মদ। তিনি তখন জাতীয় সংসদ সদস্য (এম এন এ/মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) ছিলেন।
২২ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা ফেনীকে মুক্ত রাখতে পেরেছি। ২২ তারিখে খাজা আহাম্মদ সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অনেক যুবক ভারতের চোত্তাখোলা ও একিনপুরে চলে যান। মা, দুই ভাই, পাঁচ বোন আমাদের মামার বাড়িতে চলে যান। বাবা ২৩ তারিখে ভারতে চলে যান। বাবা ভারতের কোথায় গিয়েছেন, তখন জানতে পারিনি। ১০-১৫ দিন পর বাবার একটা চিঠি নিয়ে আমার দ্বিতীয় বোনের দেবর কবির আমাদের মামার বাড়িতে আসে। সে একটি চিঠি আমাকে দেয়। বাবা লিখেছেন, ‘মোতালেব তোমার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছি, তুমি চলে আস, ইতি তোমার বাবা’। তখন জানতে পারি তিনি ভারতে বিলোনিয়া মডেল হাই স্কুলে ইয়ুথ রিসেপশান ক্যাম্পের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাবার চিঠি মাকে দেখাই। মা তখন ভীষণ কান্নাকাটি করছিলেন। বাবা ফেনী শহরের একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ইতোমধ্যে আমাদের দোকান ও শহরের বাসা লুট হয়ে যায়। একদিকে বাবা দেশে নাই, অন্যদিকে ব্যবসা ও বাসা লুণ্ঠিত। কত বছর যুদ্ধ চলবে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। তার ভেতর আমাকেও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ভারতে যেতে হবে। আম্মা যেতে দিতে চাইছিলেন না। তারপরও আমি দেশে থেকে মরার চাইতে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করে মরার ইচ্ছার কথা মাকে জানাই।
সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কবির ও আমি ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে কবিরদের বাড়ি বক্স মাহমুদ ইউনিয়নের কুহুয়া গ্রামের দিকে রওনা হই, যা ভারত বর্ডারের কাছে। সেই রাতে তাদের বাড়িতে থাকি এবং পরের দিন কবিরকে নিয়ে বক্স মাহমুদ পূর্ব পার্শ্বের রাস্তা পার হয়ে ভারতের মতাই বাজারে পৌঁছাই। সেখান থেকে জিপে বিলোনিয়ায় বাবার নিকট যাই। বাবা ভীষণ খুশি হন এবং আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বাড়ির খবরাখবর শুনতে চান। আমি ফেনীর সার্বিক অবস্থা ও পারিবারিক অবস্থা বাবাকে জানাই।
বিলোনিয়া থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা ট্রাকে করে আমাদের উদয়পুর নিয়ে যাওয়া হয়। উদয়পুরে একদিন একরাত থাকার পরদিন আগরতলার শ্রীধর ভিলায় শেখ ফজলুল হক মনির নিকট যাই। পরের দিন দুপুরে আমাদেরকে আগরতলা বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদেরকে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর এয়ারপোর্টে নেওয়া হয়। সেখান থেকে দেরাদুনের টেন্ডুয়া ক্যান্টনমেন্টে। ৪৫ দিনের ট্রেনিং দেওয়া হয় আমাদের। এটি ছিল ভারতের প্রধান গেরিলা ট্রেনিং কেন্দ্র।
ট্রেনিং শেষ হওয়ার দিন সমাপনী বক্তব্য রাখেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং ভারতের গেরিলা চিফ জেনারেল ওবান। সেখানে ট্রেনিং ক্যাম্পে দায়িত্বে ছিলেন মেজর মালহোত্রা ও লেফট্যানেন্ট কর্নেল এম এল চৌহান। ট্রেনিং শেষে আমাদেরকে আবার আগরতলা স্কুলে আনা হয়। আমাদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ঢাকা যার যার এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
সব গ্রুপকে এল এম জি, সাব-মেশিন গান, অটোমেটিক রাইফেল, এনারগা, গ্রেনেড, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও মাইন দেওয়া হয়।
আমরা আমাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। ৩য় দিন কোরবানপুর অঞ্জু মিয়াদের বাড়িতে অবস্থান নেওয়ার পর দিন বেলা ১১টায় রাজাপুরে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা এসে আমাদেরকে ঘেরাও করে। তাদের আক্রমণের কিছুক্ষণ আগে আমরা খবর পেয়ে রাস্তার পূর্ব দিক খোলা রেখে তিনদিকে অবস্থান নেই। বাড়ির তিনদিকে নালা ছিল। ইতোমধ্যে তারা পূর্ব দিক থেকে গুলি করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। আমাদের রেঞ্জের ভেতরে আসার পর এল এম জি, অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাই। তাদের অনেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং কয়েকটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ফেলে পালিয়ে যায়।
তারপর তারা রাজাপুর বাজার ছাড়া অন্য বাজার- যেমন সিন্দুরপুর বাজার দরবেশের হাট বাজার, ক্রোশমুন্সি বাজারে আসার চেষ্টা করে নাই। তখন থেকে বিরাট একটা এলাকা মুক্ত হিসাবে আমাদের আওতায় চলে আসে এবং আমাদের ওপর জনগণের আস্থা বাড়তে থাকে।
আমাদের মধ্যেও সাহস ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ২/১দিন পর আমরা খবর পাই যে, সেনবাগে কানকির হাটে শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভূঞার নেতৃত্বে যে দল ছিল, তাদের ওপর রাজাকার ও পাকিস্তান সেনাদের একটি দল আক্রমণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কানকির হাটের দিকে যাই এবং তাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সেখানেও রাজাকারেরা পিছু হটে এবং আমরা সেই এলাকাও মুক্ত করি। ইতোমধ্যে আমরা রাজাপুর রাজাকার ক্যাম্পে এবং বিরলী ব্রিজ রেকি করি। আমাদের এলাকার আরও নিরাপত্তার জন্য এই ক্যাম্প ও ব্রিজকে চলাচলে অনুপযোগী করা গেলে আমাদের রাজাপুর, সিন্দুরপুর, ক্রোশমুন্সি, দরবেশের হাট এলাকার জনগণ এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে অবস্থান করতে পারব। ২১ অক্টোবর রমজানের প্রথম রাত্রে দুই দলে বিভক্ত হয়ে আমরা বিরলী ব্রিজ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক দিয়ে চলাচলের অনুপযোগী করে দিই এবং রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে রাজাকারদের বিতাড়িত করি। এরপর আমরা আমাদের এলাকাকে নিরাপদ করে তুলতে সক্ষম হই।
সোনাগাজী এলাকায়ও বি এল এফ (মুজিব বাহিনী) হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে। ফাজিলপুরে এফ এফ বাহিনী ও পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সারা ফেনী জেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে পাকবাহিনী ফেনী শহরে গিয়ে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বীরত্বের সঙ্গে পরশুরাম, ফুলগাজী, মুন্সিরহাটে যুদ্ধ করে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে উত্তরাঞ্চল মুক্ত করে পাকিস্তান বাহিনীকে ফেনী শহরে অবস্থান নিতে বাধ্য করেন। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নোয়াখালীর দিকে চলে যায়। আমরা ফেনীকে ৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হই এবং চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৬ তারিখে ফেনী শহরে একত্রিত হয়। সেই দিন সাধারণ জনতার যে বিজয় উল্লাস দেখেছি, তা আমাদের যুদ্ধকালীন সব দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল। এই বিজয়ের পেছনে মুক্তিকামী জনতার সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি আমরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। *
*বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ফেনী জেলার সাবেক কমান্ডার
অনুলিখন: তোফায়েল আহাম্মদ নিলয়, ফেনী প্রতিনিধি