মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে ঘটেনি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্যই আমি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হয়েছিলাম ১৯৬৭ সাল থেকে। তখন আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৯৬২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই আমি ছাত্রলীগ করতাম। ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া ছয় দফা আন্দোলন ১৯৬৭ সালেও আমরা করেছি। যদিও পাকিস্তানিরা তা কখনো মেনে নেবে না, আমরা সেটি জানতাম। কারণ ছয় দফা মানলে পাকিস্তান ছয় টুকরো হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে আমরা স্বাধীনতার আন্দোলনে যুক্ত হলাম। ১৯৬৮ সালে আমরা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে স্লোগান দিতে লাগলাম ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। ‘আমার বাড়ি তোমার বাড়ি, গ্রাম বাংলা প্রতিবাড়িই’। ১৯৬৯ সালে এসব স্লোগানের সঙ্গে যুক্ত হলো ‘জয় বাংলা’। ১৯৭০ সালে যুক্ত হলো ‘পাকিস্তান চৈতন্যগলির গোরস্থান’। এটি ছিল শুধু চট্টগ্রামের স্লোগান।
এর আগে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে বের হলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন। আন্দোলন আরও জোরদার হলো। অসহযোগ আন্দোলন এল। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে বাংলাদেশের জনগণ সার্বিকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ল। আমরা যেসব স্লোগান ১৯৬৮ সাল থেকে দিয়ে এসেছি, সেগুলো জনগণের মুখে শোনা গেল ১ মার্চ থেকে। সেদিন হঠাৎ ঘোষণা করা হলো ৩ মার্চ পাকিস্তান পার্লামেন্ট বসার কথা ছিল, সেটি স্থগিত করা হয়েছে। তখন জনগণ এর প্রতিবাদ করে। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, এখানে তীক্ষ্ণ নজর দিলে বোঝা যাবে তিনি প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণাই করেছেন।
তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি, এ জন্য তাতে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হয়ে যেতেন। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়ায় আমরা তখন বঙ্গবন্ধুর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত মিটিং-মিছিল হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন হলো। তবে এর আগেই ওই বছরের ১ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একটি ট্রেনিং সেন্টার করেছিলাম। এরপর সিটি কলেজ, এমইএস কলেজ, আমবাগান ও আগ্রাবাদ এলাকায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো।
মোট কথা, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতার পতাকা উঠল- এসব মিলিয়ে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। খুব গর্বের সঙ্গে বলতে হয় মেজর রফিক ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের হালিশহর ক্যাম্পে প্রায় ১৫০ জনের মতো অবাঙালি সৈনিককে মেরে তিনি চট্টগ্রাম শহর দখল করেন। তিনি যদি সেদিন এ কাজ না করতেন সমস্যা হতো, কারণ চট্টগ্রামে বিহারিদের সংখ্যা তখন বেশি ছিল। এর আগে ১৮ মার্চ মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ, পাহাড়তলী ছাত্রলীগ, আগ্রাবাদ ছাত্রলীগ মিলে আন্দরকিল্লায় থাকা একটি বন্দুকের দোকান আমরা লুট করি। মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ আরও কিছু ছাত্রনেতা মাদারবাড়ীতে কিছু অস্ত্র লুট করেন। কমিউনিস্ট পার্টির শাহ আলমের নেতৃত্বেও কিছু অস্ত্র লুট হয়। অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগেই সাধ্যমতো নেওয়া হয়েছিল। সারা বাংলাদেশেই কিন্তু একই চিত্র। পর্যায়ক্রমে আমরা মার্চ মাসের শেষ দিকে মেডিকেল কলেজ থেকে ভারতে চলে যাই, সেখানে প্রশিক্ষণ নিই।
এফএফ প্রশিক্ষণ শেষে আমরা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করি। কিন্তু তখন এপ্রিলের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ডে যুদ্ধ চলছিল। আমরা তখন দেশে প্রবেশ করতে পারিনি। তখন আমাদের কমান্ডার জিয়াউর রহমান সঙ্গে নিয়ে গেলেন। আমাদের প্রাথমিক কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়া। তার নির্দেশে আমরা শুভপুর ব্রিজের পাশে অবস্থান করি। যদি পাকবাহিনী আসে তাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা ছিল। আমার সঙ্গে ছিল কাশেম, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ শরীফ, ফয়েজ, মনসুরসহ অনেকে। সম্ভবত তিন দিন অপেক্ষা করার পরও আমরা শত্রুর দেখা না পেয়ে রামগড়ে চলে যাই। সেখানে দু-এক দিন পর ১ মে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। আমাদের বেশ কয়েকটা গ্রুপকে একটা পুকুরপাড়ে বসিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে আমি সর্বপ্রথম আরেকজনের সহায়তা নিয়ে এলএনজি চালালাম। আমাদের রাস্তার দিকে তাক করে গুলি চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ একজন বলল, মাহফুজ ভাই, কেউ তো নেই। সবাই চলে গেছে না বলে। পুকুরের কাছেই ফেনী নদী। আমরাও নদী পার হয়ে ওপারে যেতেই দেখি পাঞ্জাবিরা ট্রেসার বুলেট ছুড়ছে। আমরা যদি পুকুরপাড়ে আর ১৫ মিনিট থাকতাম, তাহলে আমরা দলের সবাই মারা যেতাম। ওখান থেকে চলে গেলাম তান্দুয়া। ওখানে বিএলএফ ট্রেনিং নেওয়ার পর চট্টগ্রাম ঢুকলাম। আমার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ও ইঞ্জিনিয়ার হারুনের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ, ডা. মাহবুবের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ গঠিত হলো।
এর আগে একটি কথা বলে নিই। বেতার চালু হয় ২৬ মার্চ। কিন্তু কাজের ব্যস্ততার কারণে বেতার শুনতে পারিনি। ২৭ মার্চ ডা. এম এ মান্নান এসে বলেন, ‘তোরা চল বেতারে যাবি।’ আমি বললাম, বেতারে কী? তখন তিনি বললেন, বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হবে। উনি আমাদের নিয়ে ২৭ মার্চ দুপুরে বেতারে গেলেন। সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার হারুন, ডাক্তার বেলায়েত, ডাক্তার হারুন, ডাক্তার ইউসুফ, ডাক্তার সাহাবুদ্দিন ও ইঞ্জিনিয়ার আজিজ। যাওয়ার পথে আমাদের সঙ্গে রাইফেল রিভলবার ছিল। পথে অনেকটা জোর করে বেতারের একজন টেকনিশিয়ানকে তুলে নেওয়া হলো। এরপর ২৭ মার্চ বেতার চালু হলো। তখন কিন্তু আমরা সবাই ছাত্র। প্রথমে ডাক্তার মান্নান ভাইয়ের ধারণ করা একটি ভাষণ প্রচারিত হলো। মান্নান ভাইয়ের গলা অনেকটা বঙ্গবন্ধুর মতো। এরপর আমি সংবাদ পাঠক হিসেবে সংবাদ পাঠ করি। যেহেতু অপরিপক্ব প্রথম সংবাদেই ভুল করলাম। সংবাদে আমি টিক্কা খানকে মেরে ফেলি। তখন আমি সংবাদ প্রচার করি, ‘টিক্কা খান নিহত হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু নিরাপদ জায়গায় আছেন।’ এরপর বেলাল ভাই ইংরেজি সংবাদ পাঠ করলেন। ডাক্তার ইউসুফ একটি কথিকা পাঠ করলেন। এর মধ্যে একটি টেলিফোন এল। হারুন ভাই ধরলেন। তখন দেখি তিনি খুব উত্তেজিত। আমরা কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিয়া নামের এক লোক ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা এখানে কেন এলাম? আমি ভাবলাম পাঞ্জাবি। তখন আমি হারুন ভাইকে বললাম, চল চলে যাই, টেলিফোন যেহেতু করেছে, নিশ্চয় আক্রমণ করবে। তখন আমরা সেখান থেকে সটকে পড়ি।
এরপর জিয়াউর রহমান এলেন, বেতার চলল। কিন্তু সত্য কথা বলতে আমরা কখনো বেতার শুনিনি। বেতার শুনে একজন মুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। সবাই আগে থেকে গেছে। তবে বেতারের গুরুত্ব কম নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বেতার শুনেছিলেন, তারা সবাই উৎসাহিত হয়েছিলেন। একটি কথা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। তা হলো স্বাধীনতার ঘোষণা। বেতারে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন হান্নান সাহেব, দ্বিতীয় ঘোষণা দিলেন বেলাল মোহাম্মদ। এরপর আবুল কাশেম সন্দীপ, তৃতীয় ঘোষণা হলো রঙ্গলাল দেব চৌধুরী, চতুর্থ ঘোষণা আমাদের, পঞ্চম ঘোষণা হলো জিয়াউর রহমানের। মেজর জিয়াউর রহমান বেতারের মাধ্যমে প্রথমে নিজের নামে, এরপর বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। তাই জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি।
আচ্ছা, আমরা আবার যুদ্ধের ঘটনায় ফিরে আসি। তান্দুয়া থেকে ট্রেনিং নেওয়া শেষে আমরা চট্টগ্রামে প্রবেশ করি। ১৩ আগস্ট আমরা সীতাকুণ্ডে আসি। ১৬ আগস্ট অপারেশন জ্যাকপট হয়, তাই আমাদের সেখানে রেখে দেওয়া হয়। মৌলভি সৈয়দ চট্টগ্রাম শহরে একেবারে প্রথম থেকে অর্থাৎ ২৫ মার্চ থেকে লিফলেট বিতরণ, স্থানীয় যুবকদের আনসারদের সহায়তায় ট্রেনিং দিয়ে টুকটাক অপারেশন চালাচ্ছিলেন। তিনি ভারতে যেতে চাইলে তাকে মানা করা হয়েছিল। তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশ্রয় তৈরি করতে বলা হয়েছিল। তিনি তা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ মৌলভি সৈয়দের আশ্রয়ে থেকেছিলেন।
এরপর আমাদের কাজ ছিল আঘাত করে পালিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি জনগণের মনোবল বাড়ানো ও পাঞ্জাবিদের মনোবল কমিয়ে দেওয়া। আর যারা সম্মুখযোদ্ধা তাদের কাজ ছিল দখল করে এগিয়ে যাওয়া। আর এলাকা দখল করার দায়িত্ব ছিল সামরিক বাহিনীর ওপর। এটিই ছিল যুদ্ধের নিয়ম। আমার দল প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটাতে লাগল। রাজাকার ও পাঞ্জাবি হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হলো ইঞ্জিনিয়ার হারুনকে। তার সঙ্গে ছিল ডাক্তার মাহবুব ও ডাক্তার জাফর।
এরপর আরও বিভিন্ন গ্রুপ এল। নভেম্বরের শেষে এসে আমরা যৌথ অপারেশন করি। এক দিনে একই সময়ে চট্টগ্রাম শহরে ১০০টি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি আমরা। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চলছিল। একটি কথা আজ বলতেই হয়, চট্টগ্রাম শহরের গেরিলাদের যে টার্গেট দেওয়া হয়েছিল অর্থাৎ জনগণের মনোবল বাড়ানো ও পাঞ্জাবিদের মনোবল কমিয়ে দেয়। আমরা সব গ্রুপ মিলে পুরোপুরি সফল হয়েছিলাম। আমরা একটি পত্রিকা বের করতাম। নাম স্বাধীনতার পত্রিকা। এটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডাক্তার আফসারুল আমিন ও ডাক্তার মোল্লাকে। এরপর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। চট্টগ্রাম কিন্তু স্বাধীন হয়েছিল ১৭ ডিসেম্বর। সেদিন রফিক ভাই পতাকা উত্তোলন করলেন। ওই সময় আমরা উপস্থিত থাকতে পারিনি। কারণ আমরা চলে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বেতারে। আমি, ইঞ্জিনিয়ার আফসার, মঈনুদ্দিন খান বাদল, আজিজ, ইঞ্জিনিয়ার হারুন- আমরা সবাই মিলে চট্টগ্রাম বেতারে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিই।
অনুলিখন: ইফতেখারুল ইসলাম, চট্টগ্রাম
বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান