![বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা পৌঁছাল](uploads/2024/03/07/1709782881.7-March.jpg)
‘গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি’-কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষ্যে একাত্তরের ৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণই বাঙালির সবচেয়ে বড় কাব্য। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেন স্বাধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় (ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) মোট ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেয়। এ তালিকায় ৪৮ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে স্থান দেওয়া হয়। বিশ্বজুড়ে এমন অনেক ভাষণ বা নথিকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। তবে এ পর্যন্ত এসব স্বীকৃতির মধ্যে ইউনেসকো প্রথম কোনো ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা ছিল অলিখিত।
বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেসকো।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা পৌঁছাতে পেরেছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটির অডিও-ভিজ্যুয়াল ভার্সন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ শুনতে পেলেও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কতটা জানতে পেরেছে তারা। বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শকে আরও সমকালীন করে তুলতে নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথাও বলছেন ইতিহাসবিদ, গবেষকরা।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি স্বীকৃতি দেওয়ার পরে ইউনেসকো তার ওয়েবসাইটে সেই ভাষণের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সেই ভাষণ এমন একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণ্য দলিল যেখানে উত্তর-ঔপনিবেশিক একটি রাষ্ট্র অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু এ রাষ্ট্র জাতি-ধর্ম-ভাষা আর সংস্কৃতির ভিত্তিতে জনগণকে বিভক্ত করেছে।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্বীকৃতির পরে ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে এই পোস্টের সঙ্গে রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে।
ইউনেসকোর ঢাকা অফিস ও ইউনেসকোর জাতীয় কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের আওতায় ৭ মার্চের ভাষণের স্বীকৃতি এলেও ইউনেসকোর পক্ষ থেকে এই ভাষণটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান এ বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে এই ভাষণটি প্রদর্শন করা হয়। আমি প্যারিসে গিয়েছিলাম, ওখানে একটি এক্সিবিশনে দেখলাম, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল ওরা দেখাচ্ছে। এর বেশি কিছু করেছে কি না, আমার জানা নেই।’
ইউনেসকো ঢাকা অফিস ও ইউনেসকো জাতীয় কমিশন বলছে, এই ভাষণটি প্রচারের দায়িত্ব বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে, সেখানে ৭ মার্চের ভাষণটি প্রচার করা হবে, থাকবে নানা অনুষ্ঠান। তবে ভিনদেশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সে ভাষণের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য এমন অনুষ্ঠান আয়োজন কেবল দায়সারা বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা।
ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যতটুকু করার করছে, তবে তাদের ক্ষমতা সীমিত। তারা যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনুষ্ঠান করছে না বা জাতীয় দিবসগুলো ঠিকমতো পালন করছে না, এমন না। তারা কিন্তু করছে। আমার মতে, তাদের খুব বেশি কিছু করার নাই ৭ মার্চ নিয়ে।’
তবে বিভিন্ন দূতাবাস বা মিশনের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘দূতাবাসগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে আলোচনাগুলো করা হয়, তা কি গুরুত্বপূর্ণ? কোনো ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স কি তারা আয়োজন করতে পারছে বা ডেকে আনতে পারছে সে দেশের মেধাবী মানুষকে? দূতাবাসগুলো যা করে তা কেবল নিয়ম রক্ষার আয়োজন। জানি না সে আয়োজন কতটা ফলপ্রসূ হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের যে স্বীকৃতি এসেছে তার প্রেক্ষাপট, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি তো বুঝতে হবে। একটা দেশের মানুষ যারা কখনো বাংলাদেশের নামও শোনে নাই; তাদের কাছে তো আগে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে হবে একটি জাতিরাষ্ট্রের জনক হিসেবে। তিনি কীভাবে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন, সেটি জানাতে একটি আনুষ্ঠানিক জীবনীগ্রন্থ থাকতে হবে।’
করোনাকালে কুয়েত দূতাবাসের আয়োজনে ৭ মার্চের এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেই অনুষ্ঠানে দূতাবাসে কর্মরত ২০-২৫ জন কর্মকর্তা ছিলেন। সেখানে কিন্তু কুয়েতের বাঙালি কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা যেত। আমার মতে, আমেরিকা-ইউরোপের কিছু দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলোতে ৭ মার্চ বা জাতীয় দিবসের আয়োজন বড় দায়সারা গোছের। বড় কথা, এসব দেখভালও করা হয় না ঠিকমতো। বিদেশে বাঙালি রাজনীতিবিদদের নানা সংগঠন থাকে, আদর্শিক-সাংস্কৃতিক নানা সংগঠনও রয়েছে। তাদের এসব আয়োজনে যুক্ত করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণা ও রচনাবলির প্রচার নিয়ে ক্ষোভ
বিশ্বের নানা দূতাবাসে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণার কাজ থমকে যাওয়ার অভিযোগ এনেছেন ইতিহাসবিদ, গবেষকরা। তারা বলছেন, দূতাবাসগুলোতে অনেক ভিনদেশি গবেষক এসে অনুবাদকর্মের অনুমতি চাইলে তাদের যথাযথ সহযোগিতা করা হয় না। আবার কেউ বলছেন, বিভিন্ন দেশে বইমেলায় বাংলাদেশ অংশ নিলেও তাতে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক রচনাবলির বিপণন বড় দুর্বল।
ক্ষোভ প্রকাশ করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘একটি মিশনে একজন নামকরা লেখক রয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি লিখতে চেয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশে আসার অনুমতি চেয়েছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা দেয়নি। আমাদের সংগঠনের একটি ছেলে তুরস্কে থাকে। তুরস্কের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী আরও অনেক মানুষের সে ইন্টারভিউ নিয়েছে। তারা বলেছেন, কামাল আতাতুর্কের পরে বিশ্বে যদি কোনো নেতা থাকেন তবে তিনি বঙ্গবন্ধু। সেই ছেলেটি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল সে দেশের মানুষের চোখে বঙ্গবন্ধু কেমন, তা নিয়ে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাতে অর্থ ছাড় করেনি।’
২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আগে পৃথিবীর ১০০টি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী অনুবাদ করার আবেদন জানিয়েছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সেই জন্য একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাবনা ছিল তাদের। কিন্তু সরকার তাতে সায় দেয়নি বলে জানান শাহরিয়ার কবির।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে অনুষ্ঠান করা হয় তাতে বঙ্গবন্ধুকে ব্র্যান্ডিং করা হয়। বঙ্গবন্ধু কি ব্র্যান্ড করার মতো কেউ? তার জীবন আমাদের বাঙালি জাতির আদর্শ, দর্শন। সেই দর্শনের জায়গাই কি আমরা তুলে ধরতে পারছি? বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক নীতি থেকে বাহাত্তরে যে সংবিধান রচনা করলেন, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স বা ভারত তাদের সংবিধান রচনার সময় বঙ্গবন্ধুর সেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কি অনুসরণ করতে পেরেছে? আজকে পৃথিবীজুড়ে যত যুদ্ধ চলছে, তার শতকরা ৮০ ভাগেই ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে আমরা তুলে ধরতে পারি।’
বঙ্গবন্ধুবিষয়ক রচনাবলি ৪০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. দেলোয়ার হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুবিষয়ক রচনাবলির বিপণন বা প্রচারণা অনলাইন বা সরাসরি বড় দুর্বল। পৃথিবীর নানা দেশে যখন মেলা হয়, সেখানে হয়তো বঙ্গবন্ধুবিষয়ক রচনাবলিও নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এই বইগুলোর লেখক বা গবেষকদের নিয়ে যাওয়া হয় কি! সেখানে যাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। লেখক, গবেষকদের সেখানে সম্পৃক্ততার দরকার ছিল।’
তবে বাংলা একাডেমি বলছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনকর্ম, রাজনীতি নিয়ে নানা রচনাবলির অনুবাদ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মো. মোবারক হোসেন জানান, বাংলা একাডেমি ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ তিনটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ সম্পন্ন করেছে। বঙ্গবন্ধু রচনাবলি থেকে একাডেমি এবার চিঠিপত্রবিষয়ক একটি সংকলন প্রকাশ করবে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে দুই খণ্ডের সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বাংলা একাডেমি। নতুন এই রচনাবলি বা সংকলনগুলো পরে ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হবে বলে জানান মোবারক হোসেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনি স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ছড়িয়ে দিতে এক অন্য পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এই শিক্ষার্থীরা যদি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন বা অফলাইনে কোথাও সংরক্ষণ বা প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারে, তবে ভিনদেশের অনেকে তা জানতে পারবে।’