![ডামুড্যার যুদ্ধে ৭৬ পাকসেনা নিহত হয়](uploads/2024/03/19/1710838441.Faridpur-Freedom-Fighter-Ba.jpg)
ক্যাপ্টেন বাবুল নামেই আমি বেশি পরিচিত। ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলার (যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত) ৫ নম্বর আসামি ছিলাম আমি। প্রায় ৯০ বছর এখন আমার বয়স।
সশস্ত্র বিপ্লবের শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে একাধিক যুদ্ধের সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। দেশকে শত্রুমুক্ত করে ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর। বাংলা ও বাঙালির মাথা নত না করার ইতিহাস জানতে এই জাদুঘরে পরিদর্শন করেন দর্শনার্থীরা। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে নির্মোহভাবে তুলে ধরাই আমার জীবনের শেষ স্বপ্ন।
বয়েজ নেভিতে ১৯ বছর বয়সে যোগ দিই। চাকরিজীবনে লিডিং সি-ম্যান হিসেবে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছি। পালন করেছি জেলা জাসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিই। আওয়ামী লীগের জেলা ও থানা পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির পর লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত হই। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি ৯ নম্বর সেক্টরে। পরে কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফরিদপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। একাত্তরে নেতৃত্ব দিয়েছি শরীয়তপুরের ডামুড্যা, ভেদেরগঞ্জ, কাশিয়ানী ও গোপালগঞ্জে যুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিকামী মানুষের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সবুজ সংকেত। সেই মোতাবেক ২৫ মার্চ আমি যাই ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই তিনি বলেন, ‘তাড়াতাড়ি যাও এবং স্থান পরিবর্তন কর। রাতেই পাকিস্তানি সেনারা রাস্তায় নেমে পড়বে নির্বিচারে দেশের মানুষদের হত্যা করতে। তোমরা যার যার অবস্থান থেকে প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়।’ তখন আমি ফকিরাপুল এলাকার একটি বাড়িতে থাকতাম। সেখান থেকে চলে যাই লৌহজংয়ে। কয়েকদিন পর এলাকার বেশ কিছু যুবককে নিয়ে থানায় গিয়ে ওসির কাছ থেকে দশটি রাইফেল এবং দুই হাজার গুলি জোর করেই নিয়ে আসি। সময়টা তখন এপ্রিল, সেই অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকি।
সেখান থেকে চলে যাই ভারতে। সেখানে প্রথম দেখা করি মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। এরপর আগরতলার মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিই। শেখ নাসের আমাকে নিয়ে যান সাজেদা চৌধুরীর কাছে। সাজেদা চৌধুরী সে সেময় ওখানে একটি ছোট বাসায় থাকতেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাজারখানেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে আসি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী ওড়াকান্দি স্কুলে। সেখানে অবস্থান নিয়ে ক্যাম্প তৈরি করি।
একাত্তরের ৬ অক্টোবর আমরা ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে হামলা চালাই। প্রায় ৯ ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর নিশ্চিত বিজয়ের মুখে শত্রুরা আকাশ থেকে বিমান আক্রমণ শুরু করে। সেই আক্রমণে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। ওই যুদ্ধে কামার গ্রামের জাফর আলী খান ও বরাকের চরের জাহাঙ্গীর খান শাহাদাত বরণ করেন। সে সময় নগরকান্দার মেজর আজিজ আমাকে সাহচর্য দেন।
এরপর আমরা ১০ অক্টোবর ভেদেরগঞ্জের যুদ্ধে যাই। সেখানে শহিদ হন সহযোদ্ধা সর্দার মহিউদ্দিন। পরে লাশ নিয়ে তার বাড়িতে যাই। লাশ দেখে তার ছোট বাচ্চা বারবার বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে থাকে, ‘বাবা তোমার কী হয়েছে, তুমি চোখ মেলছ না কেন?’ ওই অবুঝ শিশুটিকে সেদিন আমি সান্ত্বনা দিতে পারিনি।
গোসাইরহাটের ডামুড্যায় ১৪ অক্টোবর শত্রুদের সঙ্গে ছয় ঘণ্টার তুমুল লড়াই হয়। দুই পক্ষই এলএমজি দিয়ে গুলি করেছি ও গোলাবারুদ ছুঁড়েছি। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের মেজর, ক্যাপ্টেনসহ ৭৬ জন নিহত হয়। এ সময় আমাদের আটজন শহিদ হন। তাদের ভেদেরগঞ্জের শাহজাহানপুর গ্রামে দাফন করা হয়।
একাত্তরের ২৮ নভেম্বর টুঙ্গিপাড়া গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য দোয়া প্রার্থনা করি। তাদের লুণ্ঠিত হওয়া কিছু জিনিস আমি উদ্ধার করতে সক্ষম হই। এরই মধ্যে জানতে পারি, আমার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
কোটালীপাড়ার ঘাগর বাজারে ও গোডাউন এলাকায় ২৯ নভেম্বর হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। তিন দিন যুদ্ধের পর ২ ডিসেম্বর শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আমাদের কৌশল দেখে পাকিস্তানি মেজর সেলিম রাতে লঞ্চযোগে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু টেকেরহাটে মুক্তিযোদ্ধা খলিল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে পরের দিন ভোরে গোপালগঞ্জ থানার ওসি অস্ত্রসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
আমার রণকৌশল, বুদ্ধিমত্তা, দল পরিচালনা সর্বোপরি দলের প্রতি নিষ্ঠা ও সুশৃঙ্খলাবোধে উজ্জীবিত সহযোদ্ধা ও রণক্ষেত্রের যোদ্ধারা ১৪ ডিসেম্বর আমাকে ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভাঙ্গা ডাকবাংলোয় উপস্থিত হয়ে ফরিদপুর আক্রমণের পরিকল্পনা করি।
যুদ্ধ শেষে নিজ বাসভবনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর গড়ে তুলেছি। এতে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র। রয়েছে ব্রিটিশ আলোকচিত্রী পল কনেটের তোলা মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র। সংগ্রহে আছে নিজের ও যুদ্ধকালের কিছু দুর্লভ ছবি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখনঃ সঞ্জিব দাস, ফরিদপুর প্রতিনিধি