![আর্তচিৎকার, গ্রেনেড বোমা ব্রাশফায়ারের শব্দ তাড়িয়ে ফেরে](uploads/2024/03/10/1710046860.anwar-hossen.jpg)
১৯৭১ সালে ছিলাম নরসিংদী কলেজে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এখনো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য। ঘরবাড়ি পোড়ানোর শোঁ শোঁ শব্দ, মা-বোনদের মর্মবিদারী আর্তচিৎকার, গ্রেনেড, বোমা আর ব্রাশফায়ারের ভয়ংকর শব্দ।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন, এমন খবর জানতে পারি। নরসিংদী কলেজ থেকে মা-বাবাকে না জানিয়েই চলে যাই ঢাকায়। অনেক কষ্ট করে মঞ্চের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি। কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখে সেখানেই মনে মনে শপথ করি, মৃত্যু হলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। ঝাঁপিয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধে।
বাবা বাড়িতে ছিলেন না। মায়ের দোয়া নিয়ে এলাকার অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে দেশ ত্যাগ করি। প্রশিক্ষণের জন্য ২৫ মে ভারতে গিয়ে আমরা অবস্থান করি তুরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষ করে ‘জঙ্গল ট্রেনিং’ নেওয়ার জন্য গুয়াহাটি চলে যাই। এটি ছিল তুরা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। সেখানে ছিল তিন দিনের প্রশিক্ষণ। আবারও ক্যাম্পে এসে আরও এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিই।
পরে ভারতের ঢালুতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্যাম্পে ছনের তৈরি সাধারণ ঘর ছিল। সেখানেই থাকতাম। তখন আমাদের নিয়ে দুটি কোম্পানিতে গ্রুপ করা হয়। একটি আব্দুল গনি কোম্পানি এবং আরেকটি নাজমুল আহসান কোম্পানি। অপারেশনের ইনচার্জ (ক্যাপ্টেন) ছিলেন ভারতের পক্ষ থেকে বিএসএফের বাজিত সিং।
৪ জুলাই খাসি জবাই করে আমাদের ক্যাম্পে খাওয়ানো হয়। বিকেল ৪টার দিকে ক্যাম্প ইনচার্জ (কমান্ডার) নাজমুল আহসান বললেন, শেরপুর শহর তথা সারা দেশের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য শেরপুরের কাটাখালী ব্রিজ ও তিনানীর ফেরিঘাট ধ্বংস করা দরকার। দ্রুত অপারেশনে যেতে হবে। শেরপুর-ঝিনাইগাতী-নালিতাবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কে কাটাখালী ব্রিজ পাড়ি দিয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলার আহাম্মদ নগরে ১১ নম্বর সেক্টরের বিপরীতে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় সদর দপ্তরে যেতে হতো। এ ছাড়া কোয়ারি রোড, রাংটিয়া পাতার মোড়, নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও এবং ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার অনেকগুলো ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ ও সরবরাহের একমাত্র পথ ছিল এই সেতু। চারদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রহরা ছিল। সে কারণে ব্রিজ ও তিনানীর ফেরিঘাট ধ্বংস করার কাজটি ছিল ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ।
অপারেশনের জন্য তিনটি এসএমজি আব্দুল গণি, নাজমুল আহসান ও আমার কাছে ছিল। বাকিদের ৩০৩ রাইফেল ও গ্রেনেড দেওয়া হয়। এ ছাড়া নৌকা ও ব্রিজ ওড়ানোর জন্য এক্সক্লুসিভ ও ডিনামাইট দেওয়া হয়।
৪ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনানীর ফেরি ধ্বংস করতে আব্দুল গণি ও আমি ছিলাম টু-আইসি (ইঞ্জিনিয়ার) হিসেবে। কাটাখালী ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য নাজমুল আহসানকে নিয়ে দুটি গ্রুপ করে সবাই একসঙ্গে রওনা হই। শেরপুর ও নালিতাবাড়ী থানার বর্ডারে রাঙ্গামাটিয়া গ্রামে একটি বিল ছিল।
সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে খুব ভোরে বিলের পূর্ব পাশে গিয়ে পৌঁছি। একটি বাড়ি দেখতে পাই। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে সবাই সে বাড়িতে আশ্রয় নিই। আমরা ওই দিন রাত আড়াইটায় নৌকা ও ব্রিজে বিস্ফোরণ ঘটাই। অপারেশন শেষে সবাই ভোর ৫টার দিকে রাঙ্গামাটিয়া বিলের পশ্চিম পারে একটি স্কুলের পাশে নৈমুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নিই।
এ সময় রাজাকার জালাল মিস্ত্রি দৌড়ে গিয়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে খবর দেয়। বেলা ১১টার দিকে পাকবাহিনী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে রাস্তা ব্লক করে ফেলে। পাকবাহিনীর আরেকটি দল বিলের পাশে পজিশন নেয়। আমাদের আত্মরক্ষার কোনো রাস্তা ফাঁকা ছিল না। কমান্ডার নাজমুল আহসানের নির্দেশে সব মুক্তিযোদ্ধা বিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পজিশন নেন। ডান-বাম পাশে সব মুক্তিযোদ্ধা গুলি করতে করতে বিলের পূর্ব পাশ দিয়ে ওঠার জন্য এগিয়ে যান।
তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। পাকবাহিনীর গুলিতে নাজমুল, নাজমুলের চাচাতো ভাই মোফাজ্জল হোসেন, নাজমুলের ভাতিজা আলী হোসেন, নাজমুলের গ্রামের সাঈদ মাস্টারসহ আরও কয়েকজন শহিদ হন। গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যেই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম (নৈমুদ্দিনের বাড়ি), সেই বাড়ি থেকে চলে আসার পর পাক হানাদার বাহিনী বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই পরিবারের ১১ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এ ছাড়া রাঙ্গামাটিয়া গ্রামের বেশ কয়েকজন নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিল পিশাচ হানাদার বাহিনী।
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার বড়ুয়াজানি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন নাজমুল আহসান। ১৯৬৫ সালে তিনি ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শাখা গঠনের শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন। শহিদ নাজমুল আহসানকে স্মরণে রাখার জন্য বাকৃবিতে তার নামে একটি ছাত্র হল, শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক কাটাখালী ব্রিজ এলাকায় প্রশাসনের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় দুই একর জমিতে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ নাজমুল আহসান স্মৃতি পার্ক’, শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ নাজমুল আহসানকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।
আনোয়ার হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার
অনুলিখন: কামরুজ্জামান মিন্টু, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি