![পাক সেনারা ফেনী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মারা পড়ে](uploads/2024/03/17/1710654142.pak.jpg)
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আমরা শুভপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আমি ছিলাম। সভাপতি ছিলেন ডা. আমির হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আলী আহমদ মাস্টার। ২৫ মার্চ রাতে করইয়া বাজার থেকে শত শত লোক দারোগা বাজারে যায়। উত্তেজিত জনতা দারোগা বাজার হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে মিছিল করে। এরপর শুভপুর ব্রিজ ভাঙার জন্য যায়। একই ভাবে ব্রিজ ভাঙার জন্য মিরসরাই থেকে হাজার হাজার লোক আসে এমপি মোশারফ সাহেবের নেতৃত্বে। শুভপুর ব্রিজের ওপর প্রায় ৩০ হাজার লোক গাছ, ইট দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
এরপর হেঁটে করের হাটে আমরা কিছু লোক যাই এবং গাছপালা ফেলে দিই রাস্তা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী আসতে না পারে। সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেনী হয়ে বারইয়ারহাট আসে পাকবাহিনী। বারইয়ারহাটে জনতা দেখে পাক বাহিনী গাড়ি থেকে নেমে গুলি শুরু করে দেয়। ১০-১৫ জন লোক আহত হন। তখন একটি মালগাড়ি চট্টগ্রামের দিকে যায়। ঐ গাড়িতে করে কিছু অবসরপ্রাপ্ত ই পি আর পুলিশ কুমিরার দিকে যান। তারা কুমিরার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের সঙ্গে আমরা কয়েকজন যাই।
আমরা ওখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। একটি ট্রেন ধরে গঞ্জ স্টেশনে চলে আসি। বাড়িতে এসে জানতে পারি, এমপি খায়ের আহমদ লোক পাঠিয়েছেন আমাকে বাড়িতে থাকার জন্য। কারণ যেকোনো মুহূর্তে ভারতে যেতে হবে। ৩০ মার্চ ছাগলনাইয়া আসি। আব্দুল কাদের মজুমদার ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা একটি যৌথ সভা করেন ছাগলনাইয়া পাইলট হাই স্কুলে। ওই মিটিংয়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। ৩১ মার্চ এলাকার এমপি অ্যাডভোকেট খায়ের আহম্মদ ৮-১০ জনসহ আমাদের বাড়িতে আসেন। আমরা দারোগা বাজার হয়ে ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরায় শ্রীনগর বিএসএফ ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হই।
ক্যাপ্টেন ঘোষের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তিনি আমাদেরকে বসতে দিলেন। এমপি সাহেব ও ক্যাপ্টেন মহোদয় একান্তে কথা বলেন ও যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর বিএসএফের গাড়ি দিয়ে আমাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ত্রিপুরার সাবরুমে। আমরা তিনজন গেলাম। এমপি মহোদয় বাকিদেরকে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। এমপি ও এসডিও জে এল দাসের সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করি। তিনি এমপি মহোদয়কে বলেন, আজ রাতে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সভা হবে রামগড় থানায়। রাত ১০টায় বিএসএফের প্রধান ক্যাপ্টেন ঘোষ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর আনন্দ এবং আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের নেতা আব্দুল হান্নানসহ, রফিকুল ইসলাম, এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং আমাদের এমপি আলোচনা করেন যুদ্ধ নিয়ে।
আমরা সেখানে বাইরে অবস্থান করছিলাম। আলোচনায় আসে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করার প্রসঙ্গ। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব বলেন, চট্টগ্রাম শহরের মানুষজন এখনো সরতে পারে নাই। জোরালো কণ্ঠে জিয়াউর রহমান তখন হান্নান সাহেবকে বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু করলেও চট্টগ্রাম শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে খালি করেন না। আপনি প্রস্তুত নন, কিন্তু যুদ্ধ শুরু করেন কেন?’
আমরা বাইরে থেকে এই কণ্ঠ শুনলাম। এমপি মহোদয় বের হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করলাম, ইংরেজিতে জোরালো কণ্ঠে কে বক্তব্য রেখেছেন? এমপি মহোদয় বললেন, তিনি জিয়াউর রহমান। প্রথমবার তাকে দেখলাম। এমপিসহ কিছুদিন পর বাড়িতে ফিরে এলাম। আমাদের এলাকায় (ছাগলনাইয়া) তখনও সৈন্য আসে নাই। তিন দিন পর এমপিসহ আমি ভারতে যাই। শ্রীনগরে অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করি আমরা।
বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ বিশেষ করে আলিনগর, রাধানগর, দারোগাহাট দিয়ে তখন ভারত যাচ্ছিলেন। ভারত সরকার তখনো পর্যাপ্ত রেশন ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারেনি। বিএসএফের ক্যাপ্টেন ঘোষের নেতৃত্বে এমপি খায়ের আহমদ, ডা. আমির হোসেন, অলি আহমদ মাস্টার, মো. মাহমুদুল্লাহ, সলিমুল্লাহ চৌধুরী, আব্দুল কাদের মজুমদারসহ আমি সর্বপ্রথম শ্রীনগরে বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাপ্টেন ঘোষকে অনুরোধ করি শ্রীনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার খোলা ও শরণার্থীদের রেশনের ব্যবস্থা করার জন্য।
তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রীনগর হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্থায়ী ট্রেনিং সেন্টার খোলেন। সেই ট্রেনিং সেন্টারে সর্বপ্রথমে সাত দিনের ট্রেনিং দেওয়া হয়। আমি, আব্দুল হাই মাস্টার, শাহজাহান, নবী আহমদ, নুর ইসলামসহ ১৫ জনকে ক্যাপ্টেন ঘোষ প্রশিক্ষণ দেন। এই প্রশিক্ষণে ছিল ৫-১০ জনের গেরিলা অ্যাকশন গ্রুপ, গোয়েন্দা সেল। পরে ভারতের হরিণাতে ২১ দিনের ট্রেনিং নেই। হরিণাতে ক্যাপ্টেন জালাল আহমেদ, এনামুল হক চৌধুরী ও মেজর কামরুল ইসলাম ট্রেনিং দেন।
এরপর শ্রীনগরে চলে আসি। ছাগলনাইয়া থেকে চালের গোডাউন ভেঙে শ্রীনগর ক্যাম্পে নেওয়া হয় এবং এক দিন ঢাকা-চিটাগং দারোগা বাজার মধুগ্রামের রাস্তার মাথায় আমরা চালের ট্রাকগুলো আটক করে শ্রীনগর ক্যাম্পে নিয়ে যাই।
শুভপুর ইউনিয়নের আবিদ আলী মিস্ত্রি ও ঘোপালের সলিমুল্লাহর উদ্যোগে চাল-ডাল সংগ্রহ করা হয়। শ্রীনগর ট্রেনিং ক্যাম্পে তাদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুভপুর ব্রিজ এলাকায় চলে আসে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত সৈন্য ছিল প্রায় ১০০ জন। ব্রিজের দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে আক্রমণ করে পাক সেনারা। আর মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করে। সকাল থেকে শুভপুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর শুরু হয় ব্যাপক গোলাবর্ষণ।
পাকিস্তানি ট্যাংকগুলো ফেনী নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নেয়। আমাদের অবস্থানের ওপর সরাসরি গোলাবর্ষণ করা হয়। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রাণ বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেয়। অবশেষে মৃত্যুবরণ করে। আবার দক্ষিণ দিক থেকে পাকিস্তানিরা পুনরায় আক্রমণ চালায়। আমাদের ১০-১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গোলাগুলিতে শহিদ হন।
যেহেতু পাকিস্তানি সৈন্যরা ছাগলনাইয়া রাধানগর এলাকায় চলে আসে, মেজর রফিক ইসলাম শ্রীনগর বিএসএফ ক্যাম্পে চলে আসার জন্য নির্দেশ দেন আমাদের। কর্নেল জাফর ইমামের নির্দেশে যুদ্ধকালীন কমান্ডার কামাল লোহানীসহ তার সঙ্গে চাঁদগাজী, ছাগলনাইয়া, মটুয়া, করইয়াতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করি।
পরবর্তীকালে ১ ও ২ নম্বর সেক্টরে জাফর ইমামের নির্দেশে এবং ক্যাপ্টেন ঘোষসহ ফেনী নদীর ওপরে রেলওয়ে ব্রিজ এবং ব্রিজ ভাঙার সময় তাদের সঙ্গে ছিলাম পথ-প্রদর্শনের জন্য। ফেনী মুক্ত দিবস পর্যন্ত আমরা যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম।*
বীর মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখনঃ তোফায়েল আহাম্মদ নিলয়, ফেনী প্রতিনিধি