![বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: ঐতিহাসিক দলিল](uploads/2024/03/07/1709776139.Syed-Faruq-Hossain.jpg)
স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি যখন ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে, তখনই বাঙালি জাতির পরিত্রাণের প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে যেসব নক্ষত্র উদয় হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পৃথিবীর বুকে যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে, সেই রাষ্ট্রটি গঠনের প্রধান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেজন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ তাকে দিয়েছে জাতির জনকের সম্মান।
শেখ মুজিব ছাড়া আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যেত না। ৭ মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিল না। সবই তার মনের খাতায় লেখা ছিল। তবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসার আগের নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্নপথে শেখ মুজিবকে নেওয়া হয়েছিল জনসভায়। সেদিন শেখ মুজিব সেই মঞ্চে একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। মঞ্চের কারও কাছ থেকে নেননি কোনো স্লিপ। ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে’। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকো।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ জনসভায় উপস্থিত ছিলেন এমন অনেকে বলেছেন, লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষের স্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল নীরবতা। সমগ্র বাঙালি জাতি একাগ্রচিত্তে সে ভাষণ শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। ভাষণ শেষে আবারও স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একজন দক্ষ কৌশলীর সুনিপুণ বক্তব্য। বিশেষত ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি ‘স্বাধীনতার’ কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন, যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকল না, আবার তার বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য সম্ভব ছিল না। বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠের এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এমওডব্লিউ-এ এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু তার সংক্ষিপ্ত অথচ তেজস্বী ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনীতি ও বাঙালিদের বঞ্চনার ইতিহাসের ব্যাখ্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ উপস্থাপন, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণ ও বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানে তার সর্বাত্মক চেষ্টা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ-সংগ্রাম শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেওয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবিলায় গেরিলাযুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোনো উসকানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পরামর্শদান ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরার পর ঘোষণা করেন: ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুর এ কৌশল বা অবস্থান সংগ্রামের পক্ষে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে একটি। সম্প্রতি ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনস্পয়ার্ড হিস্টরি’ (লন্ডন, ২০১৩) শিরোনামে মানবজাতির ইতিহাসের ২৫০০ বছরের ৪১ জন জাতীয় বীরের ভাষণ নিয়ে একটি বই সংকলন করেছেন। তাতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ভাষণকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। লিংকনের সে ভাষণও ছিল সংক্ষিপ্ত। মাত্র তিন মিনিটের। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও উভয়ই ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। লিংকনের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো গণতন্ত্র সম্বন্ধে তার বিখ্যাত উক্তি, ‘দিস গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল উইল নেভার পেরিশ ফ্রম দ্য আর্থ।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণ থেকে উজ্জ্বল ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ ভাষণ নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে রাতারাতি সশস্ত্র করে তোলে। একটি ভাষণকে অবলম্বন করে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি জীবন উৎসর্গ ও কয়েক লাখ মা-বোন সভ্রম বিসর্জন দেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে এ ভাষণ (বজ্রকণ্ঠ) রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করে। বলা যায়, এই একটি ভাষণ একটি জাতিরাষ্ট্র, বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্বে নজিরবিহীন।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। অনন্য সাধারণ এই নেতাকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বা ‘রাজনীতির ছন্দকার’ খেতাবেও আখ্যা দেওয়া হয়। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তার উচ্চকিত প্রশংসা করেন।
বিগত বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তি কিউবার বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘আমি হিমালয়কে দেখেনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি ছিলেন হিমালয় সমান। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্রে সভামঞ্চে ‘রাজনীতির কবি’ (নিউজউইক ম্যাগাজিনের ভাষায়, ‘পোয়েট অব পলিটিকস’) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন। বর্ণবৈষম্যবাদবিরোধী, আমেরিকার কালো মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা, বিশ্বনন্দিত মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো তার জনগণকে একটি স্বপ্নের কথা বলতে নয়, নির্দেশের অপেক্ষারত উত্তাল বাঙালি জনসমুদ্রকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানাতে। ২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ চলছিল। তৎকালীন পাকিস্তানি জনগণই শুধু নয়, বহির্বিশ্বের অনেকেও এক অনন্য উদ্দীপনা নিয়ে তাকিয়ে ছিল, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে কী বলেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য এ ছিল অন্তিম মুহূর্ত। অন্যদিকে স্বাধীনতার চেতনায় প্রদীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য এ ভাষণ ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা। এই পথ ধরে বাঙালি দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনেন একটি স্বাধীন দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এবার দেশের মানুষ নতুন করে শপথ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির পিতার স্বপ্নের সুখী, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার।
লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]