![খুলনায় গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘর : মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় নতুন মাইলফলক](uploads/2024/03/13/1710305847.Khulna-Genocide-Museum-2111.jpg)
সারা কক্ষজুড়েই নির্মমতার ছাপ। কাচ ঘেরা গ্যালারিতে সাক্ষী হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা আর নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন। কাঠের টেবিলের ওপরে রক্তমাখা হাতুড়ি, স্ক্রু, প্লাস, কাঁচি। জিজ্ঞাসাবাদের নামে এগুলো দিয়ে নির্যাতন করা হতো মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের। রাজাকাররা একটি মোটরসাইকেলে করে উল্লাস করে বেড়াতেন, সেটি রাখা আছে ঘরের একপাশে।
শহিদ বুদ্ধিজীবী গ্যালারিতে আছে শহিদ নিজাম উদ্দিন আহমদের কোট, মুনির চৌধুরীর পাঞ্জাবি, আব্দুল আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। সেই মাইকের বুলেটটি রাখা আছে সযত্নে। কোথাও গণকবর-বধ্যভূমি থেকে সংগ্রহ করে আনা শহিদের মাথার খুলি দেখে ছলছল করে ওঠে চোখের পানি। তাজউদ্দিন আহমেদ যখন ২৫ মার্চ রাতে দেশ ছাড়েন, পরিবারকে বিদায় জানানো লেখা চিরকুটটাও রয়েছে এখানে।
একইভাবে ‘কেন গণহত্যা চালাতে হবে’ পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার নিয়াজীর লেখা চিঠির তিনটা পৃষ্ঠাসহ মুক্তিযুদ্ধ সময়কালের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে খুলনার গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরে।
গবেষকরা বলছেন, ১৯৭১ সালে সারা দেশে কতটি গণহত্যা হয়েছে- স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এমন জবাব অজানাই রয়েছে। সেই তাগিদ থেকে খুলনার ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের’ আওতায় গণহত্যার ইতিহাস মাঠপর্যায় থেকে গবেষণার মাধ্যমে তুলে আনার চেষ্টা চলছে। জেলাভিত্তিক গণহত্যা-গণকবর-বধ্যভূমিসহ গণহত্যার জরিপ চালানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট গণহত্যার ওপর বিস্তৃত আলোচনা গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট (বিস্তারিত আলোচনা) গ্রন্থমালা প্রকাশ করা হচ্ছে। এরমধ্যে ৪০টি জেলার গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
গণহত্যা জাদুঘরের ডেপুটি কিউরেটর রোকনুজ্জামান বাবুল জানান, প্রতিটি গণহত্যার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শী, বেঁচে যাওয়া মানুষ, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। স্থান চিহ্নিত করে অনেক জায়গায় ফলক লাগানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১২৫টি গণহত্যা নির্ঘণ্ট (বিস্তারিত আলোচনা) প্রকাশিত হয়েছে। আরও দুটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি বলেন, খুলনার প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলে বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে অসংখ্য মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। একাত্তরের সেই গণহত্যার চিত্র তুলে ধরতে সেই বয়লারের অংশ রয়েছে জাদুঘরে। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের চিত্র জীবন্ত আকারে তুলে ধরতে জাদুঘরে রয়েছে প্রতীকী টর্চার সেল। এখানে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে লিখিত প্রেস রিলিস, ১৯৭২ সালে শহিদ পরিবারকে দেওয়া চেক, চিঠিসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুষ্প্রাপ্য সব নথিপত্র ও নিদর্শন রয়েছে। রাজাকার শান্তি কমিটির লিফলেট পরিচয়পত্রের পোস্টারও আছে জাদুঘরে।
যেভাবে শুরু হয় গণহত্যা জাদুঘর
২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনা শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে ১৯৭১; গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে খুলনার ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোডের নিজস্ব ভবনে গণহত্যা জাদুঘর নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। এ জাদুঘরের অধীনে বধ্যভূমিতে ৫০টি স্মৃতিফলক, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত প্রায় ৯ হাজার ছবি ও অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন রাখা হয়েছে। এই জাদুঘরই প্রথম ডিজিটাল জেনোসাইড ম্যাপ তৈরি করেছে।
গবেষকরা জানান, স্মৃতিফলক সংগ্রহের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্মুক্ত আহ্বান জানানো হয়। এর বাইরে মাঠপর্যায়ে যখন গবেষণা চলে তখন স্থানীয়রা বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি যশোর অঞ্চলে গবেষণাকালে যুদ্ধকালীন সময়ের একটি মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। যেটি রাজাকাররা গণহত্যার কাজে ব্যবহার করত। ঠাকুরগাঁওয়ের এক মহিলার কাছে বিয়ের একটি শাড়ি পাওয়া গেছে। যেটি ১৯৭১ সালে তার বিয়েতে উপহার দেওয়ার জন্য কেনা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেকে সেই যুবক আর কখনো ফেরেননি।
গবেষণায় খুলনার গণহত্যা চিত্র
১৯৭১ সাল। খুলনার ভৈরব তীরের ফরেস্টঘাট। নদীর তীরেই ৪১ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গলা কেটে হত্যার জন্য প্রস্তুত করা হয়। পরপর পাঁচজনকে চোখের সামনে জবাই হতে দেখেন সহকারী প্রধান শিক্ষক এফএম মাকসুদুর রহমান। তিনি ছিলেন শক্তিশালী কুস্তিগীর। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তিনি কসাইকে জাপটে ধরে নদীতে ঝাঁপ দেন। ফরেস্টঘাট গণহত্যা বইয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তার বক্তব্য রয়েছে।
একইভাবে খুলনা সার্কিট হাউসের আটচালা টিনসেড ঘরে নির্যাতন কেন্দ্র, ক্রিসেন্ট জুট মিল গণহত্যা, নসু খানের ইটভাটা গণহত্যা, আড়ংঘাটা কাপালিপাড়া গণহত্যা, চুকনগর গণহত্যার মতো সারা দেশে অসংখ্য গণহত্যার বিশদ বিবরণের ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে গণহত্যা জাদুঘরে।
জাদুঘরে কারা আসেন প্রতিদিন
এত নির্মমতা আর কোথাও নেই। ফলে অন্য জাদুঘরের মতো সময় কাটানোর জন্য কেউ এখানে প্রতিদিন আসেন না। এটা অনেকের জন্য চাপ হয়ে যায়। ফলে যারা ইতিহাস জানতে চান বা গবেষণার কাজ করতে চান মূলত তারাই এখানে বার বার আসেন। এখানে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে প্রায় ১০ হাজার বই রয়েছে। গণহত্যাবিষয়ক যত বই পুরো পৃথিবীতে বের হচ্ছে এর অধিকাংশই এখানে আছে। নতুন বই নিয়ে আলোচনা ও নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে। দিবস কেন্দ্রিক প্রোগ্রামের বাইরেও এখানে আন্তর্জাতিক সেমিনার করা হয় প্রতিবছর।
জাদুঘরের গবেষক কারা
গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের গবেষণা কাজের প্রধান ড. মুনতাসীর মামুন। চারজন বেতনভুক্ত গবেষণা কর্মকর্তা রয়েছেন। এর বাইরে গবেষণা কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে গবেষক তৈরি করা হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন গবেষকের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা গণহত্যা বিষয়ে গবেষণা করে থিসিস জমা দেন। সেই লেখা যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করা হয়।
গবেষক সহুল আহমদ জানান, শুধুমাত্র খুলনার বাদামতলা গণহত্যার ওপর ৬০ পৃষ্ঠার একটা বই আছে। সেখানে গণহত্যার পটভূমি, প্রত্যক্ষদর্শী তাদের বক্তব্য, শহিদদের তালিকা করা হয়েছে। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের একটি গণহত্যায় ৫০০ জন শহিদের নামের তালিকা করেছে গবেষক দল, খুলনার চুকনগর গণহত্যায়ও এতো শহিদের নাম উদ্ধার করা যায়নি।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মন্তব্য
খুলনা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলমগীর কবীর বলেন, গণহত্যার ইতিহাস সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে গণহত্যা জাদুঘর। যারা মুক্তিযুদ্ধ গণহত্যা সম্পর্কে জানতে চান তাদের জন্য অনেক তথ্য-উপাত্ত এখানে রয়েছে। এটি বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনার পথে আরেকধাপ এগিয়ে যাওয়া বলে মনে করছেন এই মুক্তিযোদ্ধা।