![৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা : একটি সৃজনশীল বিশ্লেষণ](uploads/2024/03/07/1709789175.Humayun-Kabir-Dhali.jpg)
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সেদিন সারা ঢাকা শহর ছিল উত্তাল। সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হতে থাকে। কারণ একটাই। পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের পূর্বপাকিস্তানের জন্য প্রণীত আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক নীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাত-অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালিদের মনে যে নতুন জাতীয় চেতনার সৃষ্টি হয়, তারই ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। এই আন্দোলন ভেতরে শানিত হয় স্বাধীনতার চেতনাদীপ্ত স্বাধিকার আন্দোলনে। যার নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত তিনিই পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের শোষণ, নির্যাতন ও একগুয়েমির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মী-সংগঠক, সমর্থক তথা প্রতিটি বাঙালির চেতনাকে শানিত করেন। স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরুদ্ধে একের পর এক সভা-সমাবেশ, আন্দোলন, হরতাল। যার ধারাবাহিকতায় এগিয়ে আসে ৭ মার্চ। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। উত্তাল জনসমুদ্র।
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ শেষে ইউনেস্কো ২০১৭ সালের অক্টোবরে ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটিসহ মোট ৭৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একই সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ)’ ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।
‘সাতই মার্চের সেই দিনটির কথা ভাবলে কত অবাক হই। বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা যেন ছিল প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার একেকজন দূত। সেদিন স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন। সেই উন্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিল। নেতা জানতেন তার মানুষের ভাষা। জনগণ বুঝত তার ইশারা। নেতার কণ্ঠের মাধুর্য তাদের জানা ছিল। তাই জাতি সেদিনই নেতার ডাক পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।’ (সূত্র: তোফায়েল আহমেদ, নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর হওয়ার প্রেরণা)।
অন্য এক আলোচনায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ ৭ মার্চের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।”
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আসার কথা ছিল দুপুর ২টার দিকে। তিনি একটু দেরি করছিলেন। তাই জনগণের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছিল। কী জানি কী হয়! উত্তাল জনতাকে শান্ত রাখার জন্য আওয়ামী লীগের নেতারা মাঝে মধ্যে বক্তব্য রাখছিলেন এবং উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গান পরিবেশন করে যাচ্ছিল। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আসেন এবং বাঙালির চিরন্তর আবেগমথিত সুর ও কণ্ঠে শুরু করেন তার বক্তৃতা-
‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।...’
এবং শেষ করেন, ‘... কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ভাষণ, একটি ঐতিহাসিক দলিল। দেশ ও রাষ্ট্রের ইতিহাসকে ছাপিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভাষণ হিসেবে পরিগণিত। ভাষণে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের যথাযথ প্রয়োগ যারপরনাই মুগ্ধতামথিত। একটি শব্দও অতিরঞ্জিত মনে হবে না। যে কটি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু, মনে হবে ওই বাক্যে ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দটির বিকল্প ছিল না। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে বলেছেন একটি মহাকাব্য। এটিকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের মতো শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণটি তুলনামূলক বিচারে ছোট হলেও শক্তিতে, বক্তব্যে, ভাবে ও ব্যঞ্জনায় মহাকাব্যের চেয়েও বড় ও বিস্তৃত। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এভাবেই তুলনা করেছেন, “লিংকনের বলা- ‘এ গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল’ আজ যেমন সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক চেতনার মর্মবাণী, তেমনি ঢাকার ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবের বলা- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম কথাটিও আজ সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কাছে মুক্তিমন্ত্রতুল্য।”
এই ভাষণ এক বিস্ময় জাগানিয়া। যেমনটি প্রাবন্ধিক-গবেষক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণে তিনি এত কথা অমন অমোঘ তীক্ষ্ণতা, সাবলীল ভঙ্গি, বাহুল্যবর্জিত কিন্তু গভীরভাবে অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া ভাষায় কেমন করে বলতে পারলেন সে এক বিস্ময় বটে!’ শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক হারুন-অর-রশিদের ব্যাখ্যায়, ‘কী চমৎকার বক্তব্য! যেমনি সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিযুক্ত, তেমনি তির্যক, তীক্ষ্ণ ও দিক-নির্দেশনাপূর্ণ। অপূর্ব শব্দশৈলী, বাক্যবিন্যাস ও উপস্থাপনা। একান্তই আপন, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।’
৭ মার্চের ভাষণের পরপরই পূর্ব বাংলার জনগণ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা না হলেও পরোক্ষভাবে এই ভাষণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক। সেদিন সারা দেশের মানুষ উন্মুখ হয়েছিল সেই ডাক শোনার জন্য।
৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে যত বিশ্লেষণ করা যাবে, ততই এর ভেতরের রাজনৈতিক সুগন্ধ বেরোবে। একজন নেতার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা স্পষ্ট ধরা পড়ে এই ভাষণে। কী নেই এই ভাষণে? রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক-নির্দেশনা কী চমৎকার ও কায়দা করে বলা হয়েছে।
রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তার ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’ বইতেও একই কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতিক ছিলেন শেখ মুজিব। সুতরাং উত্তেজিত লোকদের পক্ষে যা সম্ভব ছিল তার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাই তাকে অগ্রসর হতে হয়েছে ধীরস্থিরভাবে। শেখ মুজিব সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না করলেও জনগণকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। বস্তুত এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।’
ড. আলাউদ্দিন আল-আজাদ তার ‘ফেরারী ডায়েরী’ বইতে লিখেছেন, “মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দলিল, লিংকনের ভাষণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং ভাষণ হিসেবেও এমনি অনবদ্য যে তা নিঃসন্দেহে বিশ্বের দশটি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের অন্যতম। এ ভাষণ শুধু যেন ভাষণ নয়, এক বীজমন্ত্র যা কোটি কোটি মানুষকে শুধু উদ্দীপ্ত করেনি, এক কঠিন সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করেছে। যেন কোনো ব্যক্তি নয়, একটা আলোড়িত জাতির মর্মমূল থেকে এই ভাষণের উৎপত্তি। প্রাকৃতিক ঘটনার মতো বাংলা ভাষায় এই ভাষণ প্রকাশ পেয়েছে সেজন্য আমি গর্ববোধ করি। অনেকেই ভেবেছিলেন, সাতই মার্চের বিপুল জনসভায় মজিব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তিনি যে সরাসরি তা করলেন না, তা বিস্ময়কর। এবং এটাও তার প্রতিভা। তাঁর বক্তৃতার শেষাংশ প্রকা- একটা ‘যদি’র ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জিনিসটা ঠিক ওস্তাদের মারের মতো। রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার আহ্বান। অথচ বক্তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা আইনগত অসম্ভব। যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে সেটা ভুল নয়; গণতন্ত্রের নিজস্ব দুর্বলতা। জনতাকে হুকুম দিলে মুজিব সেদিন রাজধানী দখল করতে পারতেন। কিন্তু সে স্বাধীনতা রক্ষা করা কি সম্ভব হতো? গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবে রূপান্তর আরেক ইতিহাসের নতুন প্রস্ফুটন।”
শিল্পী হাশেম খান ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কী গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং একটি জাতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য নির্যাতিত, বঞ্চিত ও নিরীহ মানুষকে সাহস ও শক্তি জুগিয়ে উদ্বুদ্ধ করার মন্ত্র যেন। ভাষণের প্রতিটি বাক্য যেন এক একটি শক্তি সেল, সাহস ও প্রেরণার কবিতা।’
পুরো বক্তৃতার অনুপঙ্খিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বক্তৃতাতি মূলত পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদ্বয় বার্তা ও তার স্বাভাবিক অনুযাত্রায় পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রকাঠামোর পূর্বাঞ্চলের পরিসমাপ্তির প্রজ্ঞপ্তি ও বিবরণী।
৭ মার্চের ভাষণ গোটা জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল। ঘোষিত সব নির্দেশ দেশবাসী পালন করতে লাগল। “নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। ‘কর বন্দের’ আন্দোলন বহাল রইল। জরুরি অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু রাখার জন্য ৭ ও ৯ মার্চ আরও কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশ জারি করা হলো। নির্দেশ হলো রেলওয়ে ও বন্দরসমূহ চালু থাকবে, তবে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর প্রস্ততি হিসেবে সৈন্য চলাচল ও মোতায়েনের জন্যে রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হলে রেল ও বন্দর শ্রমিকরা সহযোগিতা করবে না।”
এ ছাড়া জরুরি অর্থনৈতিক তৎপরতা নিশ্চিত করতে আরও কিছু নির্দেশ দেওয়া হলো। ১১ মার্চ শেখ মুজিব জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্ট-এর নিকট বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য এক তারবার্তা পাঠান। সেই তারবার্তায় তিনি অভিযোগ করেন যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা ও সামরিক সরঞ্জামাদি এনে বাংলাদেশে মজুত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
১৫ মার্চ। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলেন। প্রায ঘণ্টা খানেক সময় বৈঠক চলল। বৈঠক শেষে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। ১৭ মার্চ শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া আবার বৈঠক করলেন। এভাবে ধাপে ধাপে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বৈঠক চলল। এই বৈঠকে মূলত যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হলো, তা হলো-
ক) সামরিক শাসন প্রত্যাহার
খ) নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং
গ) পূর্বপাকিস্তানের জন্য ছয় দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন প্রদান।
বিষয়গুলোর ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান বোঝালেন, তার পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। শেখ মুজিব বললেন যে সেটা একান্ত তার (ইয়াহিয়ার) ব্যাপার এবং তিনি ইচ্ছা করলে তা করতে পারেন। ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথা জানালেন।
শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। বৈঠক ব্যর্থ হলো। তার আগে ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চ কোনো মীমাংসা ছাড়াই ইয়াহিয়া খান গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান যাওয়ার পরপরই খবর পেয়ে যান শেখ মুজিব। বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে সেনাবাহিনী নামার আশঙ্কা করলেন অনেকে। শেখ মুজিবকেও অবহিত করলেন এ ব্যাপারটি।
নিকটজনরা আরও অবহিত করলেন, পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর আক্রোশ তখন শেখ মুজিবের প্রতি। তাই তার উচিত কোথাও সরে যাওয়া। কিন্তু শেখ মুজিব সরলেন না। রাত সাড়ে ৮টার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল সেনাবাহিনী নামবে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেনাবাহিনী নেমেও পড়ে। শুরু হয় তাদের পূর্বপরিকল্পিত আঘাত। ঢাকার সাধারণ মানুষের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক অভিযান শুরু হলো। পাক বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজারবাগ পুলিশ লাইন, হাজারীবাগ ইপিআর ক্যাম্প, আর হলগুলোসহ ঢাকা ভার্সিটি এলাকায়। ট্যাংক কামান আর মেশিন গানের গুলির শব্দে সারা ঢাকা শহর প্রকম্পিত হতে লাগল।
ঝাঁক ঝাঁক বুলেট আর গোলার আঘাতে মৃত্যুর হিমশীতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল অসংখ্য নরনারী, ছাত্র শিক্ষক ছিন্নমূল মানুষ। সে রাতেই অর্থাৎ ২৫ মার্চের রাত ১২টার দিকে শেখ মুজিব ওয়্যারলেসযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন এবং ঘোষণাটি চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামে বার্তাটি গ্রহণ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সেনারা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মিলে ঠিক করেন বার্তাটি জনগণকে বেতার মারফত জানিয়ে দেওয়ার। এর মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইপিআরের চট্টগ্রাম সদর দপ্তর অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর রফিকুল ইসলাম। কালুরঘাটে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেডিও ট্রান্সমিটার সেন্টার থেকে ঘোষণাটি ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান।
(সূত্র: আলমগীর কবীর, ৭ই মার্চের ভাষণের সামরিক দিক)
আবদুল হান্নান পঠিত স্বাধীনতা ঘোষণাটি হলো : The Pakistan Army has attacked police lines at Rajarbag and East Pakistan Rifles Headquarters at Pilkhana at midnight. Gather strength to resist and prepare for a war of Independence…
- page 24, Massacre by Robert Payne, The Macmillan Company New York.
স্বাধীনতার ঘোষণা
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা, ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয়বাংলা।’
শেখ মুজিবুর রহমান
২৬ মার্চ ১৯৭১
Declaration of independence
“This may be my last message, from today Bangladesh is independent.
I call upon the people of Bangladesh, wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”
Sheikh Mujibur Rahman
26 March 1971
পরদিন বেতার কর্মীরা কালুর ঘাট ট্রান্সমিশন ভবন থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান’ প্রচার শুরু করে। সেখান থেকেই ২৭ মার্চ তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণাটি পাঠ করেন।
তার আগে ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী শেখ মুজিবকে ধানমন্ডি ৩২ নং রোড বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসে পরে করাচি এবং তারপর মিয়ানয়ালী (পাঞ্জাব) জেলখানায় আটক রাখা হয়। ২৫ মার্চ রাতেই শেখ মুজিবের প্রধান প্রধান সহযোগীরা যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে পরিকল্পনানুযায়ী ঢাকা ত্যাগ করেন। ৭ মার্চের ভাষণ দেশের সামরিক, আধাসামরিক এবং বেসামরিক মানুষদের প্রভাবিত করে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর। পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি জনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাঙালির রাষ্ট্র গঠিত হলো। ১৭ এপ্রিল নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে।