ঢাকা ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা : একটি সৃজনশীল বিশ্লেষণ

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪, ১১:২৬ এএম
আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৪, ১১:২৬ এএম
৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা : একটি সৃজনশীল বিশ্লেষণ

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সেদিন সারা ঢাকা শহর ছিল উত্তাল। সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হতে থাকে। কারণ একটাই। পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের পূর্বপাকিস্তানের জন্য প্রণীত আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক নীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাত-অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালিদের মনে যে নতুন জাতীয় চেতনার সৃষ্টি হয়, তারই ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। এই আন্দোলন ভেতরে শানিত হয় স্বাধীনতার চেতনাদীপ্ত স্বাধিকার আন্দোলনে। যার নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত তিনিই পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের শোষণ, নির্যাতন ও একগুয়েমির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মী-সংগঠক, সমর্থক তথা প্রতিটি বাঙালির চেতনাকে শানিত করেন। স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরুদ্ধে একের পর এক সভা-সমাবেশ, আন্দোলন, হরতাল। যার ধারাবাহিকতায় এগিয়ে আসে ৭ মার্চ। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। উত্তাল জনসমুদ্র।

দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ শেষে ইউনেস্কো ২০১৭ সালের অক্টোবরে ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটিসহ মোট ৭৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একই সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ)’ ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।

‘সাতই মার্চের সেই দিনটির কথা ভাবলে কত অবাক হই। বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা যেন ছিল প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার একেকজন দূত। সেদিন স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন। সেই উন্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিল। নেতা জানতেন তার মানুষের ভাষা। জনগণ বুঝত তার ইশারা। নেতার কণ্ঠের মাধুর্য তাদের জানা ছিল। তাই জাতি সেদিনই নেতার ডাক পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।’ (সূত্র: তোফায়েল আহমেদ, নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর হওয়ার প্রেরণা)।

অন্য এক আলোচনায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ ৭ মার্চের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।”

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আসার কথা ছিল দুপুর ২টার দিকে। তিনি একটু দেরি করছিলেন। তাই জনগণের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছিল। কী জানি কী হয়! উত্তাল জনতাকে শান্ত রাখার জন্য আওয়ামী লীগের নেতারা মাঝে মধ্যে বক্তব্য রাখছিলেন এবং উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গান পরিবেশন করে যাচ্ছিল। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আসেন এবং বাঙালির চিরন্তর আবেগমথিত সুর ও কণ্ঠে শুরু করেন তার বক্তৃতা- 

‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।...’

এবং শেষ করেন, ‘... কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ভাষণ, একটি ঐতিহাসিক দলিল। দেশ ও রাষ্ট্রের ইতিহাসকে ছাপিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভাষণ হিসেবে পরিগণিত। ভাষণে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের যথাযথ প্রয়োগ যারপরনাই মুগ্ধতামথিত। একটি শব্দও অতিরঞ্জিত মনে হবে না। যে কটি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু, মনে হবে ওই বাক্যে ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দটির বিকল্প ছিল না। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে বলেছেন একটি মহাকাব্য। এটিকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের মতো শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণটি তুলনামূলক বিচারে ছোট হলেও শক্তিতে, বক্তব্যে, ভাবে ও ব্যঞ্জনায় মহাকাব্যের চেয়েও বড় ও বিস্তৃত। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এভাবেই তুলনা করেছেন, “লিংকনের বলা- ‘এ গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল’ আজ যেমন সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক চেতনার মর্মবাণী, তেমনি ঢাকার ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবের বলা- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম কথাটিও আজ সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কাছে মুক্তিমন্ত্রতুল্য।”

এই ভাষণ এক বিস্ময় জাগানিয়া। যেমনটি প্রাবন্ধিক-গবেষক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণে তিনি এত কথা অমন অমোঘ তীক্ষ্ণতা, সাবলীল ভঙ্গি, বাহুল্যবর্জিত কিন্তু গভীরভাবে অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া ভাষায় কেমন করে বলতে পারলেন সে এক বিস্ময় বটে!’ শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক হারুন-অর-রশিদের ব্যাখ্যায়, ‘কী চমৎকার বক্তব্য! যেমনি সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিযুক্ত, তেমনি তির্যক, তীক্ষ্ণ ও দিক-নির্দেশনাপূর্ণ। অপূর্ব শব্দশৈলী, বাক্যবিন্যাস ও উপস্থাপনা। একান্তই আপন, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।’

৭ মার্চের ভাষণের পরপরই পূর্ব বাংলার জনগণ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা না হলেও পরোক্ষভাবে এই ভাষণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক। সেদিন সারা দেশের মানুষ উন্মুখ হয়েছিল সেই ডাক শোনার জন্য।

৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে যত বিশ্লেষণ করা যাবে, ততই এর ভেতরের রাজনৈতিক সুগন্ধ বেরোবে। একজন নেতার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা স্পষ্ট ধরা পড়ে এই ভাষণে। কী নেই এই ভাষণে? রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক-নির্দেশনা কী চমৎকার ও কায়দা করে বলা হয়েছে।

রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তার ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’ বইতেও একই কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতিক ছিলেন শেখ মুজিব। সুতরাং উত্তেজিত লোকদের পক্ষে যা সম্ভব ছিল তার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাই তাকে অগ্রসর হতে হয়েছে ধীরস্থিরভাবে। শেখ মুজিব সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না করলেও জনগণকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। বস্তুত এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।’

ড. আলাউদ্দিন আল-আজাদ তার ‘ফেরারী ডায়েরী’ বইতে লিখেছেন, “মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দলিল, লিংকনের ভাষণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং ভাষণ হিসেবেও এমনি অনবদ্য যে তা নিঃসন্দেহে বিশ্বের দশটি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের অন্যতম। এ ভাষণ শুধু যেন ভাষণ নয়, এক বীজমন্ত্র যা কোটি কোটি মানুষকে শুধু উদ্দীপ্ত করেনি, এক কঠিন সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করেছে। যেন কোনো ব্যক্তি নয়, একটা আলোড়িত জাতির মর্মমূল থেকে এই ভাষণের উৎপত্তি। প্রাকৃতিক ঘটনার মতো বাংলা ভাষায় এই ভাষণ প্রকাশ পেয়েছে সেজন্য আমি গর্ববোধ করি। অনেকেই ভেবেছিলেন, সাতই মার্চের বিপুল জনসভায় মজিব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তিনি যে সরাসরি তা করলেন না, তা বিস্ময়কর। এবং এটাও তার প্রতিভা। তাঁর বক্তৃতার শেষাংশ প্রকা- একটা ‘যদি’র ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জিনিসটা ঠিক ওস্তাদের মারের মতো। রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার আহ্বান। অথচ বক্তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা আইনগত অসম্ভব। যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে সেটা ভুল নয়; গণতন্ত্রের নিজস্ব দুর্বলতা। জনতাকে হুকুম দিলে মুজিব সেদিন রাজধানী দখল করতে পারতেন। কিন্তু সে স্বাধীনতা রক্ষা করা কি সম্ভব হতো? গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবে রূপান্তর আরেক ইতিহাসের নতুন প্রস্ফুটন।”

শিল্পী হাশেম খান ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কী গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং একটি জাতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য নির্যাতিত, বঞ্চিত ও নিরীহ মানুষকে সাহস ও শক্তি জুগিয়ে উদ্বুদ্ধ করার মন্ত্র যেন। ভাষণের প্রতিটি বাক্য যেন এক একটি শক্তি সেল, সাহস ও প্রেরণার কবিতা।’

পুরো বক্তৃতার অনুপঙ্খিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বক্তৃতাতি মূলত পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদ্বয় বার্তা ও তার স্বাভাবিক অনুযাত্রায় পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রকাঠামোর পূর্বাঞ্চলের পরিসমাপ্তির প্রজ্ঞপ্তি ও বিবরণী।

৭ মার্চের ভাষণ গোটা জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল। ঘোষিত সব নির্দেশ দেশবাসী পালন করতে লাগল। “নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। ‘কর বন্দের’ আন্দোলন বহাল রইল। জরুরি অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু রাখার জন্য ৭ ও ৯ মার্চ আরও কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশ জারি করা হলো। নির্দেশ হলো রেলওয়ে ও বন্দরসমূহ চালু থাকবে, তবে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর প্রস্ততি হিসেবে সৈন্য চলাচল ও মোতায়েনের জন্যে রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হলে রেল ও বন্দর শ্রমিকরা সহযোগিতা করবে না।”

এ ছাড়া জরুরি অর্থনৈতিক তৎপরতা নিশ্চিত করতে আরও কিছু নির্দেশ দেওয়া হলো। ১১ মার্চ শেখ মুজিব জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্ট-এর নিকট বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য এক তারবার্তা পাঠান। সেই তারবার্তায় তিনি অভিযোগ করেন যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা ও সামরিক সরঞ্জামাদি এনে বাংলাদেশে মজুত বৃদ্ধি করা হয়েছে।

১৫ মার্চ। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলেন। প্রায ঘণ্টা খানেক সময় বৈঠক চলল। বৈঠক শেষে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। ১৭ মার্চ শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া আবার বৈঠক করলেন। এভাবে ধাপে ধাপে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বৈঠক চলল। এই বৈঠকে মূলত যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হলো, তা হলো-
ক) সামরিক শাসন প্রত্যাহার
খ) নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং
গ) পূর্বপাকিস্তানের জন্য ছয় দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন প্রদান।

বিষয়গুলোর ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান বোঝালেন, তার পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। শেখ মুজিব বললেন যে সেটা একান্ত তার (ইয়াহিয়ার) ব্যাপার এবং তিনি ইচ্ছা করলে তা করতে পারেন। ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথা জানালেন। 

শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। বৈঠক ব্যর্থ হলো। তার আগে ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চ কোনো মীমাংসা ছাড়াই ইয়াহিয়া খান গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান যাওয়ার পরপরই খবর পেয়ে যান শেখ মুজিব। বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে সেনাবাহিনী নামার আশঙ্কা করলেন অনেকে। শেখ মুজিবকেও অবহিত করলেন এ ব্যাপারটি।

নিকটজনরা আরও অবহিত করলেন, পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর আক্রোশ তখন শেখ মুজিবের প্রতি। তাই তার উচিত কোথাও সরে যাওয়া। কিন্তু শেখ মুজিব সরলেন না। রাত সাড়ে ৮টার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল সেনাবাহিনী নামবে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেনাবাহিনী নেমেও পড়ে। শুরু হয় তাদের পূর্বপরিকল্পিত আঘাত। ঢাকার সাধারণ মানুষের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক অভিযান শুরু হলো। পাক বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজারবাগ পুলিশ লাইন, হাজারীবাগ ইপিআর ক্যাম্প, আর হলগুলোসহ ঢাকা ভার্সিটি এলাকায়। ট্যাংক কামান আর মেশিন গানের গুলির শব্দে সারা ঢাকা শহর প্রকম্পিত হতে লাগল।

ঝাঁক ঝাঁক বুলেট আর গোলার আঘাতে মৃত্যুর হিমশীতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল অসংখ্য নরনারী, ছাত্র শিক্ষক ছিন্নমূল মানুষ। সে রাতেই অর্থাৎ ২৫ মার্চের রাত ১২টার দিকে শেখ মুজিব ওয়্যারলেসযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন এবং ঘোষণাটি চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামে বার্তাটি গ্রহণ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সেনারা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মিলে ঠিক করেন বার্তাটি জনগণকে বেতার মারফত জানিয়ে দেওয়ার। এর মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইপিআরের চট্টগ্রাম সদর দপ্তর অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর রফিকুল ইসলাম। কালুরঘাটে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেডিও ট্রান্সমিটার সেন্টার থেকে ঘোষণাটি ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান।
(সূত্র: আলমগীর কবীর, ৭ই মার্চের ভাষণের সামরিক দিক)

আবদুল হান্নান পঠিত স্বাধীনতা ঘোষণাটি হলো : The Pakistan Army has attacked police lines at Rajarbag and East Pakistan Rifles Headquarters at Pilkhana at midnight. Gather strength to resist and prepare for a war of Independence…
- page 24, Massacre by Robert Payne, The Macmillan Company New York.

স্বাধীনতার ঘোষণা
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা, ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয়বাংলা।’

শেখ মুজিবুর রহমান
২৬ মার্চ ১৯৭১

Declaration of independence
“This may be my last message, from today Bangladesh is independent. 
I call upon the people of Bangladesh, wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”
Sheikh Mujibur Rahman
26 March 1971

পরদিন বেতার কর্মীরা কালুর ঘাট ট্রান্সমিশন ভবন থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান’ প্রচার শুরু করে। সেখান থেকেই ২৭ মার্চ তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণাটি পাঠ করেন। 

তার আগে ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী শেখ মুজিবকে ধানমন্ডি ৩২ নং রোড বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসে পরে করাচি এবং তারপর মিয়ানয়ালী (পাঞ্জাব) জেলখানায় আটক রাখা হয়। ২৫ মার্চ রাতেই শেখ মুজিবের প্রধান প্রধান সহযোগীরা যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে পরিকল্পনানুযায়ী ঢাকা ত্যাগ করেন। ৭ মার্চের ভাষণ দেশের সামরিক, আধাসামরিক এবং বেসামরিক মানুষদের প্রভাবিত করে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর। পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি জনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাঙালির রাষ্ট্র গঠিত হলো। ১৭ এপ্রিল নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে।

একাত্তরের যুদ্ধ মুক্তির, নাকি স্বাধীনতার

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪, ০২:০৮ পিএম
একাত্তরের যুদ্ধ মুক্তির, নাকি স্বাধীনতার
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

একাত্তরের যুদ্ধ মুক্তির ছিল, নাকি স্বাধীনতার? উভয়েরই। ৭ মার্চের সেই বিখ্যাত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান দুয়ের কথাই বলেছিলেন; ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখন এবং যুদ্ধের পরও এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। কিন্তু পার্থক্য নিশ্চয়ই ছিল। নইলে পরে জিয়াউর রহমানের সময়ে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে ‘মুক্তি’ সরিয়ে নিয়ে সে জায়গায় ‘স্বাধীনতা’ বসানো হলো কেন, কেন প্রয়োজন পড়ল এই সংশোধনের? স্মরণ করা যাক, আমাদের আদি সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে, এক নম্বর অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছিল, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’ ১৯৭৮-এ জারি করা এক ফরমানের বলে সংবিধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রস্তাবনার ওপরে লেখা হয়েছে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ এবং প্রথম অনুচ্ছেদের যেখানে ছিল ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’-এর কথা, সেখানে তো বদল করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ।’ শুধু তাই নয়, এর পরে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যেখানে অঙ্গীকারের কথা আছে সেখানেও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ কেটে বসানো হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ’।

সেই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থার কথা এবং বাদ দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আদি সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল এবং তার স্থান ছিল জাতীয়তাবাদের পরই। অর্থাৎ প্রথম অঙ্গীকার জাতীয়তাবাদের, দ্বিতীয় অঙ্গীকার সমাজতন্ত্রের। সংশোধনীতে সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়া হয়নি সত্য, কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সর্বশেষে এবং সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্র অর্থ ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।’ আদিতে নাগরিকদের জাতীয়তাবাদ ছিল বাঙালি, সংশোধনের ফলে তা দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি। সংবিধানের দুটি পাঠ ছিল, একটি বাংলা, অপরটি ইংরেজি; বলা হয়েছিল অর্থের ব্যাপারে দুই পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠই গ্রাহ্য হবে। ১৯৭৮-এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে বিরোধের ক্ষেত্রে ইংরেজি পাঠই প্রাধান্য পাবে। সংশোধনগুলো মোটেই পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়; তারা একটি অভিন্ন চিন্তাধারার প্রতিফলন বটে। ওই চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে আছে একেবারে সূচনাতেই, প্রস্তাবনার সংশোধনীতেই যেখানে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’কে রূপান্তরিত করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধে’। ব্যাপারটা যত নিরীহ মনে হয় তত নিরীহ নয়। যুদ্ধ একাত্তরের ব্যাপার বটে, কিন্তু সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, সংগ্রাম একাত্তরে শুরু হয়নি, শেষও হয়নি। ১৯৭৮-এ যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত তারা যুদ্ধটাকেই দেখতে চেয়েছেন। সংগ্রামকে উপেক্ষা করে। যুদ্ধে তারা ছিলেন, সংগ্রামে ছিলেন না। আর মুক্তি ও স্বাধীনতা যে এক নয় তাও তারা খেয়াল করেছেন। মুক্তি অনেক ব্যাপক ও গভীর ব্যাপার। স্বাধীনতা বলতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বোঝানো সম্ভব, কিন্তু মুক্তি বলতে বোঝাবে সার্বিক মুক্তি। হ্যাঁ, স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়েছে একাত্তরে। অবশ্যই। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীনতা থেকে বের হয়ে এসে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। কিন্তু সেটা একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। অথবা বলা যায়, মূল লক্ষ্য ছিল অনেক বিস্তৃত। সেটা ছিল জনগণের মুক্তি। যে জন্য রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের উল্লেখ করতে হয়েছে, বলতে হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের কথা। অঙ্গীকার করতে হয়েছে এ চারটি মূলনীতি প্রতিষ্ঠার। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা প্রয়োজন ছিল ওই সর্বাত্মক লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যই। স্বাধীনতা প্রথম পদক্ষেপ, মুক্তি চূড়ান্ত লক্ষ্য। সংগ্রাম ছিল মুক্তির। 

মুক্তির জন্য সংগ্রামটা দীর্ঘকালের। এ লড়াইয়ে নানা মানুষ এসেছে, সংগঠন এসে যোগ দিয়েছে। সবার ভূমিকা সমান নয়। নানা মাত্রার ও মাপের। কিন্তু সব স্রোত মিলেই বৃহৎ ধারাটি তৈরি। হঠাৎ করে অভ্যুত্থান ঘটেনি। ভুঁইফোড় নয়। একাত্তরে শুরু নয়, শেষও নয়। মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে এবং চলবে। 

মুক্তিযুদ্ধ ছিল ওই জনগণেরই যুদ্ধ। তারাই লড়েছে। কোনো একটি রণাঙ্গনে নয়, সর্বত্র, সব রণাঙ্গনে; কেবল দেশে নয়, বিদেশেও। বলা হয়েছে, যোদ্ধাদের শতকরা ৮০ জন ছিল কৃষক। এ কোনো অতিরঞ্জন নয়। গ্রামে-গ্রামে, প্রান্তে-প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই যুদ্ধ। পাকিস্তানি শাসকদের মধ্যে কুটিল যারা তারা আশা করেছিল সংঘর্ষ সীমাবদ্ধ থাকবে। বেছে বেছে হত্যা করা হবে। কট্টর আওয়ামীপন্থি, ছাত্র, পুলিশ, বিদ্রোহী সেনা- এদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পারেনি, নৃশংস সৈন্যদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা বাছবিচার করেনি। আর জনগণও বসে থাকেনি। আক্রমণকে তারা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর আঘাত হিসেবে দেখেনি, দেখেছে তাদের নিজেদের ওপর আক্রমণ হিসেবে। সেভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অংশ নিয়েছে যুদ্ধে। ভাষা আন্দোলনের সময়েও এ রকমটাই ঘটেছিল। আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, প্রথম দিকে সীমাবদ্ধ ছিল সেখানেই। কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যখন ছাত্রহত্যা ঘটল, তখন আন্দোলন ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। ছাত্রহত্যাকে দেশবাসী নিজেদের ওপর আক্রমণ হিসেবেই দেখেছে, অন্য কোনোভাবে নয়। এর আগে পুলিশ ধর্মঘট হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল বেশ কয়েকজন বাঙালি পুলিশকে, কিন্তু সে ঘটনা বায়ান্নর ঘটনার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে এই যে, পুলিশের সঙ্গে জনগণের বিচ্ছিন্নতা ছিল, ছাত্রের সঙ্গে ছিল না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বেগবান ও সফল হয়েছে জনগণের অংশগ্রহণের ফলে। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছিল জনগণের কারণে। 

জনগণই পাকিস্তান এনেছিল ভোট দিয়ে ১৯৪৬-এ। তারাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গেছে বায়ান্নতে। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে স্পষ্ট রায় দিয়েছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান জনগণেরই অভ্যুত্থান বটে। মূল লক্ষ্য একটাই, মুক্তি। মুক্তির এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই একাত্তরের যুদ্ধ, যে যুদ্ধে পরাভূত হয়েছিল দুর্ধর্ষ বলে কথিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। যুদ্ধের পেছনে যে চেতনা সেটা মুক্তির, যে মুক্তির সংজ্ঞা পাওয়া গেছে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে। মূলনীতিগুলো যুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণ থেকেই বের হয়ে এসেছে, স্বাভাবিকভাবে। নইলে কারও সাধ্য ছিল না তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে; যেমন যুদ্ধের সময়ে ও তার অব্যবহিত পরে কারও সাধ্য ছিল না তাদের অস্বীকৃতি জানায়। শাসনক্ষমতা যখন জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে গেল, তখনই সম্ভব হয়েছে মূলনীতির সংশোধন। মুক্তির জায়গায় এসেছে স্বাধীনতা।

মুক্তির-যুদ্ধ ছিল একটা স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম। স্বতঃস্ফূর্ততার বহু গুণ ও সীমাবদ্ধতা তার মধ্যে পাওয়া যাবে। প্রধান গুণ হচ্ছে যুদ্ধের শক্তি ও বেগ; প্রধান দুর্বলতা তার সংগঠিত রূপ। যুদ্ধটা সংগঠিত, পরিকল্পিতভাবে শুরু হয়নি, চলেওনি। বিপরীতে পাকিস্তানিরা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত। তাদের ছিল বিদেশি শক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন মিত্র বলতে বাঙালির প্রায় কেউই ছিল না। ভারত যে যুক্ত হয়েছে তা আগের কোনো যোগাযোগের কারণে নয়, ঘটনা পরম্পরায়। একে সে প্রতিবেশী, তার ওপর ছিল শরণার্থীর বোঝা। 

এমনকি যারা ছিল নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগও এ কথা বলেনি যে, যুদ্ধ তারা শুরু করেছে। বলেছে যুদ্ধ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ যে ঐক্যবদ্ধ ছিল তাও নয়। সেখানে যেমন তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন, তেমনি ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাজউদ্দীন আপসে বিশ্বাসী ছিলেন না, খন্দকার মোশতাক সব সময়ই আপসের পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীনের আশপাশে যারা ছিলেন তারাও সবাই যে তার সঙ্গে ছিলেন; তা নয়। বিরোধ ছিল, যে জন্য মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল। খন্দকার মোশতাকরা যে শক্তিহীন ছিলেন না তা বোঝা গেছে ১৯৭৫-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডে। এও তাৎপর্যহীন নয় যে, তার আগেই মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বাদ পড়ে গেছেন, মোশতাক বাদ পড়েননি। যুদ্ধের সময়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি উঠেছিল। সেটা গৃহীত হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। তবে ছাড় হিসেবে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিল, কিন্তু সেই পরিষদের একটিরও বেশি বৈঠক হয়নি। জাতীয় সরকার গঠনের দাবি স্বাধীনতার পরও তোলা হয়েছিল। গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শত্রু কে ছিল? শত্রু ছিল তারাই যারা জাতীয় মুক্তির বিপক্ষে ছিল। অর্থাৎ আল-বদর, রাজাকারসহ সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের সমর্থকরা। দক্ষিণপন্থিরা। শত্রু ছিল তারা যারা মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে মনে করেছে এবং নতুন রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগোতে না দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছে, বড় পাকিস্তান ভেঙে ছোট পাকিস্তান গড়বে ভেবেছে। ১৯৭৮-এর সাংবিধানিক সংশোধনগুলো দক্ষিণপন্থিদেরই কাজ। এরশাদের সময়ে পুঁজিবাদের পথকে আরও প্রশস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রবর্তন পশ্চাৎগমনেচ্ছুদের আরেকটি বিজয় চিহ্ন। দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার বর্তমান সরকারের শাসনামলে ওই সব ফরমানকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করা হয়েছে। 

কিন্তু শেখ মুজিব এই দক্ষিণপন্থিদের প্রধান শত্রু মনে করেননি। বামপন্থিরা তার মিত্র ছিল না এটা ঠিক, কিন্তু তারা তার জন্য তত বড় শত্রু ছিল না, যত বড় শত্রু ছিল তার আশপাশে লুকিয়ে থাকা দুর্বৃত্তরা। 

যখন বাঙালিদের দাবির মুখে পাকিস্তানিরা ‘এক মানুষ এক ভোট’ নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এর আগে ছিল সংখ্যাসাম্য; অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ৫৬ জনকে কেটেছেঁটে সমান করে দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ জনের। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়েই করানো হয়েছিল ওই কাজ, নইলে পাকিস্তানিরা নিজেরা পারত না। সংখ্যাসাম্য ভেঙে পড়ল যখন, তখন জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ববঙ্গকে দিতে হলো ১৬৯টি, পশ্চিম পাকিস্তান পেল ১৪৪টি। আশা করেছিল ভোটের সময়ে বাঙালিকে বিভক্ত করা যাবে। যখন দেখল পারল না, তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল গণহত্যায়। 

জনগণ সংগ্রাম করেছে, কিন্তু মুক্তি পায়নি। রাষ্ট্র এখন কতটা স্বাধীন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়। কিন্তু জাতি যে মুক্ত নয় সেটা সন্দেহাতীত। জাতি বলতে জনগণকেই বোঝায়। সেই জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতার ধারেকাছে নেই। দেশে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু উন্নতি মানে বড়জোড় ২০ জনের উন্নতি এবং ৮০ জনের অবনতি। ধনী-দরিদ্রের তারতম্য বোঝাতে আকাশপাতালের উপমা অগ্রাহ্য নয়। ওই দুই প্রান্তের মধ্যেই বিভিন্ন স্তরের বিন্যাস। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম চলছে। সরবে নয় নীরবে। তাকে চলতেই হবে, নইলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী, দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? 

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভয়াল ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস আজ

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪, ০১:০০ এএম
আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৪, ০৫:৩৯ পিএম
ভয়াল ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস আজ
ছবি : সংগৃহীত

আজ সেই বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনের শেষে বাঙালি জাতির জীবনে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের নীলনকশা অনুযায়ী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে।

বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামকে থামিয়ে দিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল তারা। এ সশস্ত্র অভিযানকে অপারেশন সার্চলাইট নাম দেওয়া হয়। এ অভিযান শুরুর পরই বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। 

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমন অবস্থায় ঢাকায় এসে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন ইয়াহিয়া। অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে ২৫ মার্চ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান তিনি। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন লিখেছেন, ‘সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় আরও তিন হাজার মানুষকে। ঢাকায় এ ঘটনা তখন মাত্র শুরু হয়েছিল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা লাশগুলো কাক-শিয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সারা বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি।’

২৫ মার্চ ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানায় অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাংক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।

পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পাননি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। সেখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।

যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ রাত ১১ থেকে ১১টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে। তবে কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনা এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে। বেলা ২টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর বা সুবিধাজনক সময়ে দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনা করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে একই কর্মসূচি পালন করা হবে।

ইপিআর ক্যাম্পে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াই ২৮ মার্চ

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪, ১০:০৩ এএম
আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪, ১০:০৩ এএম
ইপিআর ক্যাম্পে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াই ২৮ মার্চ
বীর মুক্তিযোদ্ধা ম. হামিদ

১৩ মার্চ, ১৯৭১। দ্রুতযান ট্রেনে ঢাকা থেকে চলছি ময়মনসিংহের পথে। লক্ষ্য, ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টার। ওটা দখল করে নিতে হবে প্রথমেই। জেলা হেডকোয়ার্টার আমার গ্রামের বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। 

২৫ মার্চ রাতের এত সব ঘটনার কিছুই আমরা সে রাতে জানতে পারিনি। আমার আব্বা আলহাজ এম এ ওয়াদুদ ২৬ মার্চ ভোরে দ্রুত বাড়িতে ফিরে এসে আমাকে ডাকতে শুরু করলেন, ‘হামিদ তুই এখনো ঘুমিয়ে আছিস। ওদিকে ঢাকায় ছাত্রদের, পুলিশ, ইপিআরদের সব মেরে ফেলল। আর তুই ঘুমাচ্ছিস?’ 

আমি পোশাক পাল্টে সাইকেল নিয়ে সোজা চলে এলাম ইপিআর ক্যাম্প এলাকায়। ক্যাম্পের দুই দিকে মূল সড়কের পাশের গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড তৈরির কাজ শুরু করে দেওয়া হলো। 

ফিরে এলাম খাগডহর বাজারে। এখানে লোকসমাগম বাড়ছে। কেউ একজন বলে উঠল, ইপিআর ক্যাম্পের ভেতরে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে হবে। তখন সব দোকানেই বাঁশের মাথায় একটা করে পতাকা ওড়ানো। সেই সবুজ ও লালের মাঝে হলুদ মানচিত্র আঁকা পতাকা। একটা দোকান থেকে বাঁশসহ পতাকা খুলে নিয়ে রওনা দিলাম ইপিআর ক্যাম্পের দিকে। 

আমার সঙ্গে কুড়ি-পঁচিশজন যুবক। আমি হাঁটছি সবার আগে। প্রায় দেড় শ গজ পথ পাড়ি দিয়ে দাঁড়ালাম ইপিআর ক্যাম্পের গেটে। পেছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। আমার পাশে একজন মাত্র কিশোর দাঁড়িয়ে। মনের ভেতরে জেদ চেপে বসেছে, ভেতরে ঢুকবই। আমি আর সেই কিশোর পতাকা হাতে ভেতরে এগিয়ে চলছি। 

প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে পতাকাস্ট্যান্ড। বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রসহ সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। ছাদে বসানো এলএমজি। সবার চোখ আমাদের দিকে। পাকিস্তানের পতাকাস্ট্যান্ডের সামনে একজন সেন্ট্রি অস্ত্রসহ দাঁড়িয়ে। সেখানে মেজর নুরুল ইসলাম আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। টেবিলে আমার সামনে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস। টেবিলের ডান পাশে বসে মেজর নুরুল  ইসলাম, তার পাশে লে. মান্নান। আলোচনা ক্রমে উত্তপ্ত হচ্ছে। আমাদের বলা হলো, আমরা যেন পতাকা নিয়ে ফেরত যাই। আমি শর্ত দিলাম ফেরত যেতে পারি, তবে পাকিস্তানের পতাকা নামাতে হবে। তুমুল বাদানুবাদের পরে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন দেখলাম পাকিস্তানের পতাকা স্ট্যান্ডে নেই। তার পাশে আরেকটি স্ট্যান্ডে ইপিআরের পতাকা উড়ছে। 

২৬ মার্চ সন্ধ্যায় আমাদের ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ সফল হলো না। কিন্তু ২৭ মার্চ মধ্যরাতের  আক্রমণের পর সারা রাত যুদ্ধ চলল। ২৮ মার্চ বেলা ১১টায় বাঙালি ইপিআর বাহিনীর অংশগ্রহণে আমরা জয়লাভ করলাম। ২৬ মার্চ সকালে যে পতাকাস্ট্যান্ড থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে এসেছিলাম, ২৮ মার্চ সকালে সেখানে আমরা বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালাম।

বীর মুক্তিযোদ্ধা, সহসভাপতি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম 
‘ফিরে দেখা একাত্তর’ বই অবলম্বনে

নাটোরের মালখানা ভেঙে অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করি

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১০:৫৮ এএম
নাটোরের মালখানা ভেঙে অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করি
বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু

একাত্তরের ২৭ মার্চ তৎকালীন নাটোর টাউন পার্কে (বর্তমানের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ) সর্বদলীয় এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ন্যাপের প্রয়াত নেতা খন্দকার আবু আলীকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। শুরু হয় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ। 

পাকসেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য আগ্রহী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ওই প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে আসেন মহকুমা খাদ্য কর্মকর্তা পাবনার ক্যাপ্টেন (অব.) হাবিবুর রহমান। শহরের শুকলপট্টি এলাকায় নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা কলেজের পুরাতন হোস্টেল চত্বরে (বর্তমানের রানী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজ) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অন্যদের সঙ্গে তিনিও নেওয়া শুরু করেন ওই প্রশিক্ষণ। 

কিন্তু বেশি দিন প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব হয়নি। কেননা এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাকসেনাদের অবস্থান জানা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য শহরের কান্দিভিটা এলাকার রিক্রিয়েশন ক্লাবে স্থাপন করা হয় কন্ট্রোল রুম। খবর পাওয়া যায়, নাটোরে আসছে পাকসেনা। শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলা হয়। এরই অংশ হিসেবে শহরের তৎকালীন মিনার সিনেমা হলের মোড়ে (বর্তমানের ছায়াবাণী সিনেমা হল) তেলের বড় বড় ড্রাম ও বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। গোপন স্থানে (পাশের জনতা স্টোরের ছাদে) বিভিন্ন হালকা ও তীর-ধনুকসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে রাতে পাহারাও দিতে থাকে সাঁওতালদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু যোদ্ধা। নাটোরের মালখানা ভেঙে অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। 

পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের মুখেও ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু পরে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অনেকেই পাড়ি জমান ভারতে। আমিও তাদের সঙ্গী হই। সঙ্গে নিই বাবা রশীদুর রহমান ও মা নুরুন নেসা বেগমকে। শুরু হয় ভারতে ট্রেনিং।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পাবনা বেড়া এলাকার তৎকালীন এমসিএ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার কুড়মাইল এলাকার একটি স্কুল ভবনে ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করে তা পরিচালনা করতেন। আমি ওই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিই। পরে মালঞ্চ এলাকায় আরও একটি মুক্তিযোদ্ধাদের ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করার পর আমিসহ কয়েকজনকে সেখানে পাঠানো হয়। কয়েক দিন পর আবারও তাদের কুড়মাইল ক্যাম্পে আনা হয়। 

পরে গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়ী এলাকার পানিঘাটা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এই ক্যাম্পে আমার সঙ্গে পরিচিত হন বগুড়া নট্রামসের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মান্নান। এই ক্যাম্পে মাঝে মাঝেই প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতেন আমাদের চলচ্চিত্র জগতের শক্তিমান অভিনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল এবং চিত্রনায়িকা কবরী। পরে অর্টিলারি ট্রেনিংয়ের জন্য প্রথমে রায়গঞ্জ সেনা ক্যাম্প এবং পরে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়ী এলাকার পানিঘাটায় (বাগডোগরা) ক্যাম্পে পাঠানো হয় আমাদের। সেখানে গেরিলা, অ্যাডভান্স ও জেএলসি (জুনিয়র লিডার কোর্স) বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।

এরপর ভারতের বাগডোগরা, রায়গঞ্জ হয়ে পানিঘাটাসহ বিভিন্ন স্থানে গেরিলা ও জুনিয়র লিডার কোর্সসহ ভারী অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং শেষে প্রথমে গেরিলা এবং পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেনা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় ‘তুফানিয়া ব্যাটালিয়ন’- ব্র্যাভো সেক্টর নামে একটি ব্যাটালিয়ন। 

মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে ওই ব্যাটালিয়নের সদস্য হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার, আলফা, চার্লি, ডালডা, ব্র্যাভোসহ বিভিন্ন কোম্পানির সমন্বয়ে তুফানিয়া ব্যাটালিয়ন ব্র্যাভো সেক্টর গড়ে তোলা হয়। ওই ব্যাটালিয়নে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই যোদ্ধাদের মধ্যে আমার বয়সী প্রায় দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। 

কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় সেনাসদস্য মেজর মতিলাল চৌধুরী। বালুরঘাটের সীমান্ত এলাকা অযোধ্যায় মাটির নিচে বাঙ্কার করে ওই ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এই ক্যাম্প থেকে যৌথবাহিনীর সঙ্গে প্রতিদিন বাংলাদেশের নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি ও হিলি এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতাম। এরই ধারাবাহিকতায় তুফানি ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার ভারতীয় সেনাসদস্য মেজর মতিলাল চৌধুরীর কমান্ডে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সেকশন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা বগুড়ার এরুলিয়া গ্রামের জাকারিয়া তালুকদারের নেতৃত্বে সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নিই।

যুদ্ধের একদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। অযোধ্যা ক্যাম্প থেকে রাতে ভারতীয় সেনাসদস্য সুবেদার দেলবর সিংয়ের নেতৃত্বে আমিসহ ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বাংলাদেশের নওগাঁ সীমান্তের ফার্সিপাড়া-নওগাঁ রাস্তার ব্রিজ ধ্বংস করাসহ গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে রওনা হই। তীব্র শীতের রাতে রওনা হওয়ার পর পথে একটি নদী পড়ায় থামতে হয় সবাইকে। বিবস্ত্র হয়ে নদী পার হতে বাধ্য হলাম। কেননা নির্দেশটি ছিল কমান্ডারের। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। নদীটি পার হয়ে ফার্সিপাড়া রাস্তার ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই আচমকা পাকসেনাদের আক্রমণের মুখে পড়লে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। যুদ্ধকালীন বিশেষ সাংকেতিক শব্দে একত্রিত হলেও কমান্ডারের নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছিল না। বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলির একপর্যায়ে নিজেদের বুদ্ধিতে পাকসেনাদের আনুমানিক অবস্থান লক্ষ্য করে আমাদের সঙ্গে থাকা ৬ ইঞ্চি মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে থাকি। একপর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকসেনারা। ফেলে যায় দুটি জিপ গাড়ি। সেই গাড়ি দুটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যাই। তবে প্রতিকূল অবস্থার পরও এই যুদ্ধে আমাদের কোনো যোদ্ধা হতাহত হয়নি। 

একদিন হিলি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে পাকসেনাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ি। সেখান থেকে পিছু হটে পাঁচবিবি সীমান্ত দিয়ে দেশের ভেতর ঢুকে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। ১২ ডিসেম্বর রংপুরের গোবিন্দগঞ্জ মুক্ত হলে আমরা বগুড়ার উদ্দেশে রওনা হই। পথে বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া শত্রুমুক্ত হয়। এসব যুদ্ধে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অনেক সদস্য শহিদ হন। পাকসেনাও নিহত হয় অনেক। পরে বগুড়ার পুলিশ লাইনে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। 

সম্মুখযুদ্ধের সময় আমাদের ভারতীয় মিত্রবাহিনীর পোশাক সরবরাহ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার খবরে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হই। নাটোরে আসার জন্য ছটফট করতে থাকি। আমাদের অস্ত্র জমা নেওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর নাটোরের পথে রওনা হই। কিছু পথ হেঁটে এবং কিছু পথ ট্রেনে নাটোরে আসি। নাটোরে আসার সময়ও আমার পরনে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর নাটোরে ফিরে আসি। কিন্তু তখনো নাটোর শত্রুমুক্ত হয়নি। নাটোর শত্রুমুক্ত হয় ২১ ডিসেম্বর।

বীর মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন: কামাল মৃধা, নাটোর প্রতিনিধি

পাকসেনাদের সহযোগী বাবাকে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪, ১০:৪০ এএম
আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১০:৫৮ এএম
পাকসেনাদের সহযোগী বাবাকে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আইয়ুব আলী সরকার

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে আবেগাপ্লুত, উদ্দীপ্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। 

মে মাসের ১৬ তারিখে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে গাইবান্ধা থেকে বোয়ালিয়া চরে যাই। নদী পার হওয়ার জন্য মাঝির সঙ্গে যোগাযোগ হয়। একসঙ্গে আরও ছয়টি নৌকা যাত্রা শুরু করে। কিছুদূর এগোনোর পর মাঝনদীতে বাকি ছয়টি নৌকাই ডুবে যায়। নদীটির নাম ধরলা। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার পর আমাদের মাঝি নৌকা চালানো বন্ধ করে রাখেন। ঘণ্টা দুয়েক পর আবার যাত্রা শুরু হয় আমাদের। 

বিকেল নাগাদ মৌলার চর ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে ১৫ দিনের ট্রেনিং গ্রহণ করি। ক্যাপ্টেন হামিদ পালোয়ানের নেতৃত্বে পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশন টিমের সঙ্গে অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। গাইবান্ধার কুপতলা, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর তুলসী ঘাট বল্লমঝড়সহ আরও বিভিন্ন স্থানে আমরা অপারেশন পরিচালনা করি। 

আগস্ট মাসের শেষের দিকে বাস ও লঞ্চযোগে  ভারতের ধুবড়ির উদ্দেশে রওনা হই। 

সেখানে পৌঁছার পর ট্রেনযোগে ভোরবেলা কুচবিহারে পৌঁছাই। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করি। সেখান থেকে একদিন রাত দুইটায় ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাকেসহ ১৫ জনকে তাদের গাড়িতে করে জলপাইগুড়ি পাঙ্গা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে দেয়। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের গ্রহণ করে। থালা-বাসন ও ইউনিফর্ম দেওয়া হয় আমাদের। পরের দিন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু হয়। আমাদের দলের প্রত্যেকেই মুজিব বাহিনীর গাইডলাইন অনুযায়ী অস্ত্রবিধ্বংসী ও গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রায় দুই মাস আমাদের নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। 

এই প্রশিক্ষণ শেষে আমরা ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ নীলফামারীর ডোমার থানার ঠাকুরগঞ্জ এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করি। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন টিম লিডার মোহাম্মদ নাসিমউদ্দিন। ডেপুটি লিডার হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করি। 

আমরা যৌথ ও আলাদাভাবেও অপারেশন পরিচালনা করি। ডোমার এলাকার সোনারায় গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প করেছিল। প্রশিক্ষিত কর্মীদের মাধ্যমে গোপনে রেকি করে সবকিছু নিশ্চিত হয়ে নিই আমরা। রাত্রে প্রথম পার্টি, দ্বিতীয় পার্টি ও তৃতীয় পার্টিকে পজিশনে রেখে রাত ১২টার দিকে আমরা ওই ক্যাম্পে আক্রমণ চালাই। কিছুক্ষণ গোলাগুলি করার পর পাকিস্তানি সেনারা প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। 

ডোমার থেকে ডিমলা যাওয়ার রাস্তায় পুরো টিমসহ অ্যামবুশের স্থান নির্ধারণ করি। রাস্তার মধ্যে আমরা  মাইন স্থাপন করি। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, প্রেসার রিলিজ টাইমবোমা, পুল টাইম বোমা স্থাপন করে আমরা পজিশন গ্রহণ করি। 

আমাদের টিমের একজনের বাড়ি ছিল সেই এলাকায়। ওই পথের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার বাবা আমাদের দেখে ফেলেন। তিনি পাকসেনাদের গাড়ি আমাদের অ্যামবুশ করা জায়গায় আসতে বাধা দেন। ফলে  আমাদের মিশন ব্যর্থ হয়। এ ঘটনায় আমাদের টিমের মুক্তিযোদ্ধা আশরাফউদ্দিন তার বাবাকে নিজে গুলি করে হত্যা করেন। 

ইতোমধ্যে আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে নীলফামারীর উদ্দেশে যাত্রা করি। সেখানে পৌঁছে অন্য মুক্তিযোদ্ধা দলসহ যৌথভাবে সৈয়দপুরের উদ্দেশে রওনা হই। সেই সহযোদ্ধা আশরাফউদ্দিন সৈয়দপুরে শত্রুদের আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হন। তাকে উদ্ধার করে গাড়িতে করে রংপুর মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পথে তিনি শহিদ হন। তার লাশ রংপুরের বদরগঞ্জে বালুয়াভাটা কবরস্থানে নিয়ে আমজাদ ব্যাপারীর সহযোগিতায় দাফনকাজ সম্পন্ন করি। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি বাড়িতে ফিরে আসি। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে মুজিব বাহিনীর অস্ত্র জমা দেওয়া অনুষ্ঠানে যোগদান করি। আমার নামে ইস্যুকৃত অস্ত্র এসএমজি জমা দিয়ে দিই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা 
অনুলিখন: সাইফুর রহমান রানা, রংপুর প্রতিনিধি