![বিজয়ানন্দে সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না](uploads/2024/03/15/1710476500.priti.jpg)
একাত্তরে দেশজুড়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের যে দামামা বেজে উঠেছিল, তার ঢেউ এসে লেগেছিল পাহাড়ি জনপদেও। মুক্তিসংগ্রামের সেই ঢেউয়ে শামিল হয়েছি আমরা পাহাড়ের সন্তানরাও। পাকবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনকে রুখে দিতে জীবন বাজি রেখে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছি শত্রুর মুখোমুখি।
আমার মতো কলেজপড়ুয়া অন্যান্য তরুণও লড়েছেন বহু সম্মুখযুদ্ধে। বান্দরবানের বাসিন্দা হলেও লেখাপড়ার জন্য তখন থাকছিলাম রাঙামাটিতে। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনলাম। রক্তে যেন আগুন লেগে গেল। বান্দরবানে ফিরে গিয়ে আমরা তরুণরা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে মিলে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। একাত্তরের এপ্রিল মাসের শুরুর দিকের কথা। আমরা তখনো ট্রেনিং পাইনি। মুক্তিবাহিনী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসার বাহিনীকে সাহায্য ও রসদপত্র জোগাড় করে দিতাম তখন।
এর মধ্যেই চট্টগ্রামের কালুরঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ধীরে ধীরে পিছু হটছিলেন আমাদের যোদ্ধারা। একদিন দেখলাম ভোররাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান, কর্নেল অলি আহমদ, কয়েকজন ক্যাপ্টেনসহ আরও কয়েকজন বান্দরবান থেকে চন্দ্রঘোনা, ঘাগড়া, ফটিকছড়ি হয়ে রামগড় চলে গেছেন। আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই, প্রতিরোধও করতে পারব না। তাই এখানে থাকাও নিরাপদ মনে হলো না। তখন ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করা ২৭২ জনের একটি রিফিউজির দলের সঙ্গে আমরাও ১০ জন রওনা হলাম।
একটি বিএসএফ ক্যাম্পে দুই দিন থেকে বাসিতালং ক্যাম্পে গেলাম। সেখানে এক সপ্তাহ থেকে বনপাংশুলে জামালছড়ি ক্যাম্পে যাই। ট্রেনিংয়ে ভর্তি হলাম জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এক মাসের ট্রেনিং শেষ হলে ৪০ জন করে দুটি গ্রুপ করা হলো। আমাদের কমান্ডার ছিলেন ওহাব ভাই। অন্যটির আবদুল হামিদ। আমরা বান্দরবানে রুমায় চলে এলাম। সকালে বাজারে বসে পরিকল্পনা করে একটি দল গেল রামু-কক্সবাজারের দিকে। আমরা অপারেশন চালাব দোহাজারী, পটিয়া, চন্দনাইশ থেকে শুরু করে কালুরঘাট পর্যন্ত।
আমাদের দল দুটি বড় নৌকা নিয়ে রুমা থেকে আসার পথে আক্রমণের শিকার হই। অস্ত্র থাকলেও সবাই ঘুমিয়ে থাকায় প্রতিরোধ করতে পারিনি। আমাদের মাঝি পেটে গুলিবিদ্ধ হলো। আরেকজনের হাঁটুতে গুলি লাগল। আরেক নৌকার দুজন গুলি লেগে মারা গেলেন। প্রাণ বাঁচাতে বালুর চরে আত্মগোপন করলাম।
সেখান থেকে দুই রাত হেঁটে পৌঁছলাম চন্দনাইশে মোখলেসুর রহমানের দলের কাছে। ইপিআর, পুলিশ, আনসার আর ছাত্র মিলে প্রায় ৪৫ জনের একটি দল ছিল তার। সেখানে ছিলাম কয়েক দিন। আমাদের কমান্ডার ওহাব ভাই প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এলেন সেখানে। পরদিন সকালে মিটিংয়ে আমাকে বললেন, ‘আমরা তো ছদ্মবেশে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারব। কিন্তু তোমার চেহারা দেখে ওরা সন্দেহ করবে। তুমি এখানেই থাকো কয়েক দিন।’ সবাই চলে গেলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি থেকে গেলাম। মোখলেস বাহিনীকে কয়েক দিন এক্সক্লুসিভ ট্রেনিং সম্পর্কে কিছু টিপস দিলাম। পরে দলটির সঙ্গে লোহাগাড়ার রাজঘাটা মাদ্রাসায় অপারেশনে অংশ নিই। উভয়পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলি হলো। পাকিস্তানি আর্মি এসে হতাহতদের তুলে নিয়ে যাওয়ায় এলাকার লোকেরা পরদিন ঘটনাস্থলে শুধু রক্ত দেখেছে।
সেখান থেকেই আগস্টের শেষ দিকে ভারতে যাত্রা করা একটি রিফিউজি দলের সঙ্গে ট্যাগ হয়ে গেলাম। ক্যাম্পে ছিলাম কয়েক দিন। সেখানে এক মেজর সার্বিক পরিস্থিতি আর আমার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলেন। আমি হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে যতটা সম্ভব বললাম। তখন এক সুবেদারকে নির্দেশ দিলেন আমাকে একটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। আবার দ্বিতীয় দফায় ১৭ দিনের ট্রেনিং নিলাম।
এরপর ১০৮ জনের দল নিয়ে আমাদের কমান্ডার অশোক মিত্র কারবারির নেতৃত্বে গেলাম বরকলে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণে। সেখান থেকে রাঙ্গুনিয়া বা চন্দনাইশে ঢোকার উদ্দেশে ঠেগাখাল পার হয়ে দুমদুম্মা হয়ে রোয়াংছড়ি চলে এলাম। পথে ধোপছড়িতে মিত্রবাহিনীর ওখানে রাতে বিশ্রাম নিলাম। যাত্রাপথে সেগুনবাগানে ছিলাম দুই রাত। ওখান থেকে আমাদের দলের পাঁচ সদস্য হাতিয়ারসহ পালিয়ে যান।
রাঙ্গুনিয়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। ওখানকার চেয়ারম্যান আমাদের খাবার দিয়ে সাহায্য করলেন। পদুয়ায় দুটি খামারবাড়িতে আমরা ক্যাম্প করে আশ্রয় নিই। পাকবাহিনীর টহল দলকে বাধা দিতেই শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাগুলি। ওরা কিছুতেই পিছু হটছে না। আগুন লাগিয়ে দিল। আমরা শুকনো কুয়ার মধ্যে আত্মগোপন করলাম। আমাদের দুজন ক্যাম্পে গিয়ে মর্টার নিয়ে আসায় আবার গুলিবর্ষণ শুরু হলো। ট্রেনিংয়ে পাওয়া আমাদের গায়ের পোশাক দেখে ওরা ভাবল আমরা ভারতীয় আর্মি। একসময় ফায়ারিং বন্ধ করে চলে গেল ওরা। তখন দেখলাম এক নারী পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে তার স্বামীকে। দেখে প্রচণ্ড খারাপ লাগল আমার।
আরেক অপারেশন রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা-বাগানের কাছে। আমরা চারপাশ থেকে পাক আর্মিকে আক্রমণ করেছিলাম। প্রতিদিন গোলাগুলিও হতো। পরে পাক আর্মি চলে যাওয়ার পর সেখানে মিলিশিয়া বাহিনী আসে। ওদের চিঠি পাঠিয়ে বললাম, ‘তোমরা এখান থেকে চলে যাও! আমরা ব্যাপক অভিযান চালাব।’
এ সময় তিব্বতী বাহিনীও এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। ১২ ডিসেম্বর কর্ণফুলী নদী পার হয়ে আমরা দুই ভাগ হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত হলো, এক গ্রুপ যাবে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে। পাকবাহিনীকে আটকে দিতে আরেক গ্রুপ থাকবে চন্দ্রঘোনায়। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর অপারেশনের জন্য আমরা তৈরি হচ্ছিলাম। পরিস্থিতি বোঝার জন্য নদীর পারে পাঠালাম তিন-চারজনকে। দেখলাম, ওরা চিৎকার আর গুলি করতে করতে ফিরে আসছে। বলল, যুদ্ধে আমাদের বিজয় হয়েছে। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। এত তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ হবে- অবিশ্বাস্য মনে হলো। ভেবেছিলাম এ যুদ্ধ চলতে থাকবে বছরের পর বছর। যুদ্ধজয়ের আনন্দে সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না।
পরদিন আমরা গেলাম রাঙ্গুনিয়া কলেজে। সেখানে একজন ক্যাপ্টেন এসে অস্ত্র জমা দিতে বলায় জমা দিয়ে দিলাম। এরপর আমাদের পাঠানো হলো চট্টগ্রাম কলেজ হোস্টেলে। ওখানে গিয়ে দেখলাম, মুক্তিযোদ্ধায় ভরপুর। ওখানেই ক্যাপ্টেন এনাম কোম্পানির কমান্ডারদের ডেকে সদস্য সংখ্যা জেনে নিয়ে সার্টিফিকেটে সই করে দিয়ে বললেন, নাম লিখে নিও! আমিও একটি সার্টিফিকেটে নিজের নাম লিখে ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফিরলাম বান্দরবানে, মায়ের কাছে। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন। স্বাধীন দেশে নিজের মায়ের কাছে ঘরে ফেরার সেই আনন্দ কখনো ভুলব না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন: জিয়াউর রহমান জুয়েল, রাঙামাটি প্রতিনিধি