![কোরবানি নিয়ে যা না জানলেই নয়](uploads/2024/06/13/360_F_277985268_29W6P3mCYwKkCn399VPDvfKo5eofsCWk-1718259203.jpg)
কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে সওয়াব লেখা হয়। ইবরাহিম (আ.) নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের কাঁধে ছুরি চালিয়েছিলেন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময় কোরবানিদাতার মনটা সেই মানসিকতা ও ত্যাগের স্বরে অনুরণিত হতে হবে। আর যদি তার দেহ-মনের পরতে পরতে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তা হলে তার এই কোরবানির উৎসব নিছক গোশত খাওয়ার জন্যই হবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, ৩৭)
হারাম সম্পদের কোরবানি
হারাম সম্পদের ওপর ভিত্তি করে কোরবানি ওয়াজিব হয় না। তাই কোরবানিদাতার হালাল সম্পদ না থাকলে সন্দেহমূলক অর্থ হলেও ধার করে কোরবানি করবে এবং নিজ হালাল অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবে। (ফতোয়ায়ে শামি, ২/২৫; আপকে মাসাইল আওর উনকা হল, ৬/২৫২)
দাস বা গোলামের কোরবানি
দাস বা গোলামের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘গোলামের সম্পদে কোনো জাকাত নেই।’ (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক, ৩/১৬১)
মুসাফির ও মুকিম ব্যক্তির কোরবানি
কোরবানির সময়ের প্রথম দিকে মুসাফির থাকার পরে তৃতীয় দিন কোরবানির সময় শেষ হওয়ার আগে মুকিম হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে প্রথম দিকে মুকিম ছিল, এরপর তৃতীয় দিনে মুসাফির হয়ে গেলে; এক্ষেত্রে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব থাকবে না। অর্থাৎ সে কোরবানি না দিলে গুনাহগার হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে, ৪/১৯৬; ফতোয়ায়ে খানিয়া, ৩/৩৪৬)
নাবালেগ শিশু ও পাগলের কোরবানি
নাবালেগ (অপ্রাপ্তবয়স্ক) শিশু এবং যে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তাদের অভিভাবক নিজ সম্পদ দিয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করলে তা সহিহ হবে। (রদ্দুল মুহতার, ৬/৩১৬)
পিতার নামে কোরবানি
ছেলে কোরবানির পশু ক্রয় করে পিতার (নামে) পক্ষ থেকে কোরবানি দিলে পিতার ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে না; বরং পিতার জন্য পৃথকভাবে পশু ক্রয় করে বা ওই পশুতে নিজের মালিকানার অর্থ দিয়ে শরিক হয়ে কোরবানি আদায় করতে হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, ৫/৩০২)
অন্যের ওয়াজিব কোরবানি আদায়ের বিধান
অন্যের ওয়াজিব কোরবানি দিতে চাইলে সে ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। নইলে তার কোরবানি আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের অনুমতি ছাড়াই তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করে, তা হলে দেশীয় সামাজিক প্রচলনের কারণে তাদের কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো। (বাদায়েউস সানায়ে, ৪/২১১)
মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি
মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি অসিয়ত না করে থাকে, তা হলে সেটি নফল কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কোরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কোরবানির অসিয়ত করে যায়, তা হলে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না; বরং গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমদ, ৮৪৫)
জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি
যেমনিভাবে মৃতের পক্ষ থেকে ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরবানি করা জায়েজ, তেমনিভাবে জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ইসালে সওয়াবের জন্য নফল কোরবানি করা জায়েজ। এ কোরবানির গোশত কোরবানিদাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার, ৬/৩২৬)
দরিদ্র ব্যক্তির কোরবানির বিধান
দরিদ্র ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কোরবানির নিয়তে কোনো পশু ক্রয় করে, তাহলে তা কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। (বাদায়েউস সানায়ে, ৪/১৯২)
একান্নভুক্ত পরিবারে কোরবানি কয়টি করতে হবে
একান্নভুক্ত পরিবারে একাধিক ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে (অর্থাৎ তাদের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে) তাদের প্রত্যেকের ওপরই ভিন্ন ভিন্ন কোরবানি ওয়াজিব। একটি কোরবানি সবার জন্য যথেষ্ট নয়। (ফতোয়ায়ে শামি, ৫/২২০)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোরবানি করা
সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোরবানি করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। হানশ (রহ.) বলেন, ‘আমি আলি (রা.)-কে দেখলাম, তিনি দুটি বকরি কোরবানি করলেন। তাকে বললাম, এটি কী? (আপনার ওপর তো একটি কোরবানি করা আবশ্যক ছিল; কিন্তু দুটি করলেন কেন?)’ বললেন, ‘নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে অসিয়ত করেছেন, যেন আমি তার পক্ষ থেকে কোরবানি করি। এ কারণে আমি তাঁর পক্ষ থেকে (একটি) কোরবানি করেছি।’ (তিরমিজি, ১/২৭৫)
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব
১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে—এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। (ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া, ১৭/৪০৫)
কোরবানির নেসাব
সোনার ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য জিনিসের ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সার কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্যের হয়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে শামি, ৫/২২২)
কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির তিন দিনের মধ্যে যেকোনো দিন থাকলেই কোরবানি ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুহতার, ৬/৩১২)
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক