এখনো খোঁজ মেলেনি ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহের। প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই সোমবার (২৫ মে) কলকাতার ভাঙড়ের জিরানগাছা, কৃষ্ণমাটি এলাকায় তল্লাশি অভিযানে গিয়েছিলেন ঢাকার ডিবি কর্মকর্তারা। সঙ্গে ছিলেন রাজ্য সিআইডির শীর্ষ কর্মকর্তারা। গ্রেপ্তার কসাই জিহাদকে সঙ্গে নিয়েই তারা বিস্তীর্ণ এলাকায় তল্লাশি অভিযানে যান।
ঢাকার ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, জাল পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে ঢুকেছিলেন অন্যতম চক্রান্তকারী আমানুল্লা ওরফে শিমুল।
তিনি এও বলেন, ‘আমাদের দণ্ডবিধিতে একটি ধারা আছে, এক্সট্রা টেরিটোরিয়াল অফেন্স। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে অপরাধ করে, আমরা সেই অপরাধগুলো তদন্ত করতে পারি।’
তারা মনে করছেন, মূল সন্দেহভাজন আখতারুজ্জামান শাহীন কাঠমান্ডু থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন। মঙ্গলবারও বাংলাদেশের তদন্তকারীরা কলকাতায় থাকবেন। বুধবার তারা ঢাকা ফিরবেন বলে জানা গেছে।
তদন্ত করতে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসে সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে এদিনও দফায় দফায় বৈঠক করছেন ডিবির কর্মকর্তারা। সোমবার সকালে নিউটাউনের চিনার পার্কে আক্তারুজ্জামান শাহীনের দুটি ভাড়া বাড়িতেও তদন্ত চালান তারা। বনগাঁ সীমান্তে ধৃত জিহাদকেও একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ডিবি কর্মকর্তারা।
এই কাণ্ডে ধরা পড়ার পরেই কসাই জিহাদ হাওলাদার জানিয়েছিলেন, খুন করা হয়েছে এমপি আনারকে। তার শরীর টুকরো টুকরো করে একাধিক জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
সিআইডি সূত্রে বলা হয়েছে, সারা দিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের ফলে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে গতকালের তল্লাশি অভিযান। সারা রাত ঝড়বৃষ্টিতে বেড়ে গেছে জলের পরিমাণ, অনেক জায়গায় গাছ উপড়ে খালসংলগ্ন এলাকা ভেঙে গেছে। এদিন ভাঙড়ের বাগজোলা খাল এবং সংলগ্ন এলাকা, জলাভূমিতে খোঁজ চালিয়েছে সিআইডি। তল্লাশি অভিযানে ছিলেন সিআইডির কর্মকর্তারাসহ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিমও। এদিন ডুবুরি ও ড্রোন ক্যামেরা দিয়েও চলে তল্লাশি।
এদিকে রাজ্য পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অবসরপ্রাপ্ত এক শীর্ষ কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডে গভীর রহস্য রয়েছে। শুধু দেহের টুকরো উদ্ধার করলেই হবে না, হত্যার কারণও খুঁজে বের করতে হবে।
গত রবিবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দার অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর রশিদ কলকাতায় নেমে জানিয়েছিলেন, এমপি আনার খুনের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহীন। আরও তথ্য পেতে এ দেশের তদন্তকারীদের সঙ্গে কথা বলছেন বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। ২৩ মে বনগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জিহাদ হাওলাদারকে। জেরায় সংসদ সদস্যকে খুন করার কথা স্বীকারও করেন তিনি।
‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য দিচ্ছেন আসামিরা
এদিকে ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে থাকা আসামি তানভীর, শিমুল ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমান রিমান্ডে ভিন্ন ভিন্ন ও ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে ডিবি পুলিশ।
বিডি পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, আসামিরা ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য দিচ্ছেন। এতে মনে হচ্ছে তারা বিষয়টি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
সূত্র জানায়, আনার হত্যার ঘটনায় ভারত-বাংলাদেশে যেসব আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা একজন অন্যকে ভালোভাবে চেনেন না বলে দাবি করেছেন। রিমান্ডে এমন কিছু তথ্য উঠে এসেছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিডি পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই মামলার তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে রহস্য উদঘাটন হতে বেশ সময় লাগবে। এমন পরিস্থিতিতে এমপি আনারের মৃতদেহ যদি না পাওয়া যায় তাহলে মৃত্যুসনদ মিলবে কী করে অথবা হত্যা মামলা প্রমাণ করবে কীভাবে? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার মনে।
সূত্র জানায়, আনারের মৃতদেহ পাওয়া না গেলে কোনো ধরনের ডেথ সার্টিফিকেট বা মৃত্যুসনদ দেবে না ভারত। ওই দেশের পুলিশ বাংলাদেশ পুলিশকে এই বিষয়টি সাফ জানিয়ে দিয়েছে।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (ডিবিতে কর্মরত) খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমপি আনার খুন হয়েছেন ভারতের মাটিতে। এখনো তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। খুনের রহস্য উদঘাটন এবং তার খণ্ডিত দেহের অংশ খুঁজে বের করতে কলকাতায় আমাদের ডিবির টিম ও ভারতের পুলিশ কাজ করছে।
তিনি বলেন, আমার দীর্ঘদিন ধরে অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু এই মামলা নিয়ে আমরা অনেকটা চিন্তিত।
এই মামলার তদন্ত করছে ডিবি পুলিশের ওয়ারী বিভাগ। জানতে চাইলে ওই বিভাগের দায়িত্বশীল পুলিশের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, আসামিদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এর মধ্যে কিছু তথ্য ‘বিভ্রান্তিকর’ মনে হচ্ছে। সব কিছু মাথায় রেখে পুলিশ তদন্ত করছে। প্রথম ধাপে রিমান্ডে ভালো তথ্য না এলে দ্বিতীয়বার তাদের আবারও রিমান্ড চাওয়া হবে।
এই বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ মহিদ উদ্দিন বলেছেন, ‘পুলিশ এই মামলার তদন্ত করছে। আশা করি অপরাধীদের বিষয়ে ভালো সংবাদ পাওয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে হয়তো একটু সময় লাগতে পারে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে।’