পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের অর্থ-সম্পদ লুটপাটের মহোৎসব চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি রিসোর্ট, মৎস্য, গরুর খামারসহ বিভিন্ন সম্পদ চুরি ও লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একাধিক রিসোর্ট, ২৮টি পুকুর, মৎস্য ও গরুর খামার থেকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু চুরি বা লুট হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জে প্রকাশ্যে চুরির সময় ৬০০ কেজি মাছ উদ্ধার করে দুদক। দুই দিন আগে বান্দরবানে বেনজীরের খামারবাড়ি থেকে লুট হয়েছে ৩৬টি গরু। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে থাকা ২৮টি পুকুর ও বিভিন্ন খামারের মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। এসব সম্পত্তিতে বেনজীরের নিয়োগ করা তদারককারীরাই গোপনে এবং প্রকাশ্যে সুবিধামতো চুরি ও লুট করছেন। সম্পত্তিগুলোতে আদালতের দেওয়া ক্রোকাদেশের পর তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান থাকার সুযোগে এসব অপকর্ম চালানো হচ্ছে। এদিকে বেনজীরের আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। সেগুলোও ক্রোকের আওতায় আসবে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে শনিবার (৮ জুন) দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে দুদকের কর্মকর্তারা গোপালগঞ্জে সাভানা ইকো রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬০০ কেজি মাছ জব্দ করেন। এটা দুদকের অনেক বড় সাফল্য। ক্রোক আদেশের আওতায় থাকা এসব সম্পদ রক্ষায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’
গত শুক্রবার বিকেলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গোপালগঞ্জে বেনজীরের সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কে অভিযান চালান দুদকের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সোহরাব হোসেন সোহেল। অভিযানে ওই রিসোর্টের পুকুর ও জলাশয় থেকে চুরি হওয়ার সময় ৬০০ কেজি মাছ জব্দ করা হয়। মাছ পচনশীল হওয়ায় তা তাৎক্ষণিক নিলামে ৮৩ হাজার ৭৫৪ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ ঘটনায় মাছ চুরি ও মালিকের সম্পদ লুটের চেষ্টার অভিযোগে রিসোর্টের হ্যাচারি কর্মকর্তা সফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়। এ সময় রিসোর্টের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি রিসোর্টের যাবতীয় মালামালের তালিকা (ইনভেন্টরি) তৈরির কাজ শুরু করা হয়।
এর আগে গত ৫ জুন বেনজীর আহমেদের খামারবাড়ি থেকে ৩৬টি গরু সরিয়ে নেন খামার দেখভালের দায়িত্বে থাকা বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মংওয়েচিং মারমা। গরুগুলোর আনুমানিক বাজারমূল্য ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। একইভাবে বিভিন্ন জেলায় বেনজীর আহমেদের ৬২১ বিঘা জমি ও এসব জমিতে থাকা ফসল এবং অন্যান্য মালামালের ক্ষেত্রে লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে এসব সম্পত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হলেও আদেশের কপি জেলা প্রশাসন বা সংশ্লিষ্টদের কাছে যায়নি। এই সুযোগে বেনজীরের নিয়োগপ্রাপ্ত অসাধু ব্যক্তিরা গোপনে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে মালামাল লুট করছেন। তবে বান্দরবানে ৩৬ গরু উধাওয়ের ঘটনার পর এসব সম্পত্তিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নজরদারি জারি থাকায় গোপালগঞ্জে মাছ চুরি ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।
এদিকে বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে আরও কিছু সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের দৌলতপুর ‘নর্থস এগ লিমিটেড’ এবং নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ‘নর্থস চিকস রংপুর লিমিটেড’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের শেয়ার রয়েছে। ওই দুটি খামারে ৫০ বিঘা করে অন্তত ১০০ বিঘা জমি বেনজীরের দুই মেয়ের নামে আছে। এসব সম্পত্তির দালিলিক তথ্য দুদকে এসেছে। এ ব্যাপারে ক্রোকাদেশ চেয়ে চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন আদালতে আবেদন করা হবে বলে জানা গেছে।
সাভানা পার্কের নিয়ন্ত্রণ নিল জেলা প্রশাসন
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, আদালতের নির্দেশে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জে করা সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন এবং মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুটি টিম পার্কে প্রবেশ করে নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেয়। এরপর শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে পার্কের প্রধান ফটকের পাশে মাইকিং করে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দেয় জেলা প্রশাসন। এর মধ্য দিয়ে আদালতের ক্রোক আদেশের বাস্তবায়ন করা হলো। এদিকে জেলা প্রশাসন পার্কটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় খুশি স্থানীয়রা। তবে দখলকৃত জমি ফেরত পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অন্যদিকে গত শুক্রবার রাতে পার্কের ঘের থেকে গোপনে ৫৯০ কেজি মাছ ৮৩ হাজার টাকায় বিক্রির ঘটনা ঘটেছে।