![কুষ্টিয়ায় মৌসুমে হাতপাখা বিক্রি ৪ কোটি টাকা](uploads/2024/04/23/1713868689.kustia.jpg)
আধুনিক বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার ও যান্ত্রিক যুগেও চাহিদা কমেনি তালপাখার। কুষ্টিয়ার মটমালিয়াট, বানিয়াকান্দি ও সন্তোষপুর এলাকার দুই শতাধিক পরিবার তালপাখা বানানোর কাজে নিয়োজিত।
প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এসব এলাকার তালপাখা প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকাগুলোতে বছরে প্রায় ৩০ লাখ হাতপাখা তৈরি করা হয়। প্রতিটি পাখা পাইকারিভাবে প্রকারভেদে বিক্রি হয় ১৪ থেকে ১৫ টাকায়, ফলে এই গ্রামগুলোতে তৈরি হাতপাখার পাইকারি বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকারও বেশি।
গ্রীষ্মের উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালের পাতা ও বাঁশ দিয়ে পাখা তৈরির ধুম পড়ে যায় এসব গ্রামে। বছরে প্রায় ছয় মাস ওই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটান।
বাণিজ্যিকভাবে বংশ পরম্পরায় প্রায় ৯০ বছর ধরে এই পেশাকে টিকিয়ে রেখেছেন সেখানকার কয়েক শ মানুষ।
পাখা তৈরির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যান্ত্রিকতার এই যুগেও কুমারখালীর তৈরি হাতপাখার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে কাঁচামালের দাম বাড়ায় পাখার দাম বেড়েছে। ফলে লাভের অংশে খুব একটা পার্থক্য হয়নি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারি প্রণোদনা ও কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা এবং কাঁচামাল ও তৈরি করা পণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা আরও লাভবান হতে পারবেন।
হাতপাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে তালগাছের পাতা, বাঁশ, সুতা বা লোহার চিকন তার (জিআই তার) ব্যবহার করা হয়। সাজসজ্জার জন্য ব্যবহার করা হয় হরেক রকম রং।
প্রায় ৯০ বছর আগে গ্রামের সুকচাঁদ শেখ প্রথম তালপাতা ও বাঁশ দিয়ে পাখা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। তার কাছ থেকে তার ছেলেমেয়ে, ভাই-ভাতিজারাও পাখা বানানো শেখেন। এখন এলাকার দুই শতাধিক পরিবার এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়; চলে ভাদ্র-আশ্বিন পর্যন্ত। বছরের প্রায় ছয় মাস চলে এ কাজ। পরিবারের প্রায় সব সদস্য মিলেই তৈরি করেন পাখা। কেউ তালপাতা পানি দিয়ে ভেজানোর কাজ করেন। কেউ পাতা রোদে শুকান। কেউবা আবার পাতা কেটে সাইজ করেন, বাঁশ চিরে শলা তৈরি করেন। অনেকেই সুতা ও বাঁশের শলায় রং লাগান। এভাবেই কয়েকজন মিলেমিশে পাখা তৈরি করেন।
কারিগররা জানান, কুষ্টিয়া ও আশপাশের জেলা থেকে পাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল কেনেন। প্রতিটি তালপাতার দাম পড়ে ৮-১০ টাকা এবং একটি পাতায় ৮-১০টি পাখা তৈরি করা যায়। ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় কেনা একটি বাঁশ দিয়ে প্রায় ১০০ হাতপাখা তৈরি করা যায়।
সব খরচ মিলিয়ে ১টি হাতপাখা তৈরিতে খরচ হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। ১৫ থেকে ২০ টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি পরিবার ছয় মাসে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ হাজার করে পাখা তৈরি করে থাকে। প্রতি মৌসুমে সদকী ইউনিয়নে প্রায় ৩০ লাখ পাখা তৈরি হয়। যার বর্তমান পাইকারি বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।
মটমালিয়াট গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের পাশে, বাড়ির উঠান, বারান্দা ও বাগানে বসে পাখা তৈরি করছেন শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী নারী-পুরুষ। কেউ তালপাতা পানি দিয়ে ভেজানোর কাজ করছেন। কেউ পাতা রোদে শুকাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার পাতা কেটে সাইজ করছেন, বাঁশ চিরে শলা তৈরি করছেন। কেউবা সুতা ও বাঁশের শলায় রং লাগাচ্ছেন। কেউ আবার বিক্রির জন্য পাখাগুলোকে একত্রে বাঁধছেন।
পাখা তৈরির কারিগর ফরিদা খাতুন জানান, তার বাবা সুকচাঁদ প্রায় ৯০ বছর আগে প্রথম পাখা তৈরি শুরু করেছিলেন। এখন তার গ্রামের সবাই পাখা তৈরির কাজ করেন। ফরিদা খাতুনের ছেলে আবুল কালাম আজাদ জানান, পৈতৃক পেশা হিসেবে তিনি প্রায় ৪৫ বছর ধরে পাখা তৈরির কাজ করছেন। প্রতিটি পাখা তৈরিতে প্রায় ১০ টাকার মতো খরচ পড়ে। আর ১৪-১৫ টাকায় পাইকারি বিক্রি করেন। প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ পাখা তৈরি করে তার পরিবার। প্রতি মৌসুমে তিনি ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার পাখা বিক্রি করেন।
মটমালিয়াট গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি আমার চাচা সুকচাঁদের কাছ থেকে পাখা তৈরির কাজ শিখেছিলাম। বছরে ছয় মাস পাখা তৈরি করি আর বাকি ছয় মাস কৃষিকাজ করি। আমাদের গ্রামে প্রতি মৌসুমে প্রায় ৩০ লাখ হাতপাখা তৈরি হয়। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৪ কোটি টাকারও বেশি।’
দশম শ্রেণির ছাত্রী জেসমিন খাতুন বলে, ‘আমি পড়াশোনার পাশাপাশি পাখায় রং লাগানোর কাজ করি।’ অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তামিম হোসেন বলে, ‘আমি প্রতিদিন প্রায় ১০০ থেকে ১২০ পাখায় তার বাঁধার কাজ করি। এতে আমার আয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।’
আবেদা খাতুন নামের এক গৃহিণী জানান, সংসারের কাজের পাশাপাশি তিনি পাখা ধোয়া ও সেলাই করার কাজ করেন। এতে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করেন।
কারিগর আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আগের তুলনায় পাখার দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। কাঁচামালের দাম এখন অনেক বেশি। ফলে লাভের অংশে খুব একটা পার্থক্য হয়নি। সরকারি প্রণোদনা ও কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা এবং কাঁচামাল ও তৈরি করা পাখা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে আরও বেশি লাভবান হতাম।’
কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, ‘সদকী ইউনিয়নে দুই শতাধিক পরিবারের সদস্য হাতপাখা তৈরির কাজ করছে। উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য উপজেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে উদ্যোক্তা অ্যাপস, ম্যাপস ও মেলার ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনে সহজ শর্তে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।’